[সারসংক্ষেপ : কোরআন এবং হাদিসের নির্যাস হলো শরিয়ত এবং সুফিবাদ। শরিয়ত এবং সুফিবাদ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত দু’টি বিষয়। এদের একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অর্জন অসম্ভব। মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার প্রথম ধাপ শরিয়ত হলে চূড়ান্ত পর্যায় হবে সুফিবাদ। পৃথিবীতে প্রেরিত সকল নবি—রাসুলগণই শরিয়তের সকল বিধিবিধান পুঙ্খানুপঙ্খভাবে মেনে চলে সুফিবাদের অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কোরআনের বহুস্থানে শরিয়ত এবং আধ্যাত্মিকতা তথা সুফিবাদের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এদের একটিকে দেহের সাথে তুলনা করলে অন্যটিকে আত্মার সাথে তুলনা চলে। শরিয়তের উচ্চতম সাধনায় আত্মসংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভে চূড়ান্ত পর্যায় হলো সুফিবাদ। তাই শরিয়তের উপর ভর করেই সুফি সাধনার পথে অগ্রসর হতে হয়। সুফি সাধকগণ সর্বদা সৎকর্ম সম্পাদন করেন এবং অসৎ কর্ম থেকে বিরত থাকেন। একজন সুফি সাধক যখন শরিয়তের বিধানসমূহ পরিপূর্ণভাবে পালন করেন; তখন তাঁর মধ্যে আত্মশুদ্ধি ঘটে। এ আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে সুফিসাধক যখন আল্লাহর এরূপ পথে অগ্রসর হন; যে পথ অত্যন্ত কঠিন, দুরূহ ও বন্ধুত্বের। তখন সাধকের জন্য কিছু পন্থা বা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। এ পন্থা বা পদ্ধতিগুলো শিক্ষা লাভের জন্য সাধক এমন এক ব্যক্তির শরণাপন্ন হন, যিনি সাধনাবলে পরম সত্ত্বাকে চিনতে পেরেছেন এবং তাঁর নৈকট্য অর্জন করেছেন। তিনিই হচ্ছেন সত্যিকারে ইনসানে কামেল, আহলে হাকিকত, মুর্শিদ এবং সত্যিকারের সুফিসাধক।]
ভূমিকা
শরিয়ত এবং সুফিবাদ দুটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এমন বিষয় যে, শরিয়তকে দেহের সাথে তুলনা করলে, সুফিবাদকে আত্মার সাথে তুলনা চলে। শরিয়ত হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি। সুফিবাদের সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ স্তর হলো শরিয়ত। সর্বস্তরের মুসলমানের জন্যই শরিয়তের বিধানসমূহ অবশ্য পালনীয়। সুফিবাদ তথা আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছার মাধ্যম এবং আত্মিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের উৎস শরিয়ত। সুফিবাদের শুরু থেকেই সুফি সাধকগণ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেছেন। এ সুফিবাদের বীজ বপন হয় সর্বপ্রথম হজরত আদম আলাইহিস সালাম এর সময়; অঙ্কুরোদগম হয় হজরত নূহ আলাইহিস সালাম এর সময়; পল্লবিত হয় হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর সময়; উন্নতি লাভ করে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম এর সময়; পূর্ণতা লাভ করে হজরত ইসা আলাইহিস সালাম এর সময় এবং চুড়ান্ত পরিণতি আসে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়। একজন সুফিসাধক শরিয়তের বিধিবিধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলার পরও জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভর করে থাকেন। তাই শরিয়ত এবং সুফিবাদকে পৃথকভাবে দেখার সুযোগ নেই। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অর্জন সম্ভব নয়। অত্র প্রবন্ধে পবিত্র কোরআনে শরিয়তের গুরুত্ব, সুফিবাদের মর্মকথা, শরিয়ত ও তাসাউফ ভিত্তিক কাব্য সাহিত্যের আলোচনাসহ শরিয়ত এবং সুফিবাদ—এর পরস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে শরিয়তের গুরুত্ব
শরিয়ত বলতে জীবন চলার সেই পদ্ধতি বা নিয়ম—বিধানকে বুঝানো হয়; যা মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন এবং তা অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। শরিয়ত হল এক ধমীর্য় পথ, যা পালনের জন্য মহান আল্লাহ বান্দাদের জন্য প্রকাশ করেছেন। যেমন— নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি। সরল বা নিরাপদ রাস্তাকেও শরিয়ত বলা হয়। মানব রচিত আইনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইসলামি শরিয়ত পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা যা কালের গতি ধারায় পুরাতন বা ব্যবহারের অনুপযোগী করতে পারে না। শরিয়তের বিধান সর্বকালেই ছিল। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
অর্থ: তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ তিনি নুহকে আলাইহিস সালাম দান করেছিলেন এবং যার অহি (প্রত্যাদেশ) তোমার প্রতি করেছি। এবং যার আদেশ ইব্রাহিম, মুসা ও ঈসাকেও (এই মর্মে) করেছিলাম যে, ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতবিরোধ কর না। (সুরা শুরা—৪২ : আয়াত—১৩)
কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে,
ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِّنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاء الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ: অতঃপর (হে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমরা আপনাকে (ধমীর্য়) বিষয় সম্পর্কিত শরিয়তের (বিধানাবলির) উপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং আপনি তার অনুসরণ করুন এবং অজ্ঞদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। (সুরা জাসিয়া—৪৫ : আয়াত ১৮)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে,
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا
আমরা তোমাদের প্রত্যেকের জন্য (কালের দাবি অনুযায়ী) শরিয়ত (আইন) এবং স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। (সুরা মায়েদা—৫ : আয়াত—৪৮)
সুফিবাদের মর্মকথা
মহান আল্লাহ মানুষের দৈহিক অবয়ব সৃষ্টির বহু পূর্বেই সমস্ত রুহের সৃষ্টি করেছিলেন এবং সেই রুহদের সন্বোধন করে প্রশ্ন করেছেন—আলাস্তু বিরাব্বিকুম— আমি কি তোমাদের প্রভু (তারা বললো—হ্যাঁ); আল্লাহকে তারা প্রভু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মানুষের সাথে মহান আল্লাহর সম্পর্ক নিবিড় ও বহু পূর্বের। আল্লাহর নির্দেশে যখন রুহ মানুষের দেহে প্রবেশ করে, তখন ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, রুহকে প্রবেশ করতে হয়েছিলো। কিন্তু প্রবেশের পর থেকে নিজ দুনিয়ায় ‘আলমে আরওয়াহ’ (রুহসমূহের জগত)—এ ফিরে যাওয়ার জন্য তার ব্যকুলতা। মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের দুর্বার আকাঙ্খাকে মাওলানা রুমি (র.) বাশির সুর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বাঁশি বাজে—সেতো বাজে না, সে কাঁদে, তার প্রেয়সীর সাথে মিলনের জন্য। যেখান থেকে বাঁশিকে ছিনিয়ে নিয়ে আনা হয়েছিল, সেখানেই সে ফিরে যেতে চায়। রুহকে যে সখার কাছ থেকে, যে জগত থেকে আলাদা করে দেহের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে; সেই সখার কাছে, সেই জগতে সে ফিরে যেতে চায়। মাওলানা রুমির (র.) ভাষায়—
بشنو از ني چون حکايت مي کند
از جدايي ها شکايت مي کند
শোনো, শোনো বাঁশরীর মরম কথা
তার বিরহ—কাতর হিয়ার ব্যাকুলতা
(রূমি, ১৩৭৩ শা : ১)
আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্যে রুহের এই যে অব্যক্ত বেদনা এবং প্রেম, তাই সুফিবাদের মর্মকথা। এ তত্ত্ব কাউকে শেখানোর প্রয়োজন নেই। এই অনুভূতি মানুষের জন্মগত, যা রক্ত মাংসে মিশে আছে । এ অনুভুতির প্রকাশ ঘটেছে যুগে যুগে জাতি—ধর্ম নির্বিশেষে সকল প্রেমিকের কাব্য ও সংগীতে। বিশেষকরে ঐ একই ভাবধারার দ্যোতনা বিভিন্নভাবে ও ভংগীতে বেজে উঠেছে পারস্যের কবি হাফেযের দিওয়ানে, রুমির মাসনাভীতে, শাবিসতারীর গুলশানে বাসে, ফদিরউদ্দিন আত্তারের মানতেকুত ত্বায়েরে এবং ওমর খাইয়ামের রুবাইয়াতে। একই ভাবের অভিব্যক্তি দেখতে পাওয়া যায় শেলী, ব্রেক প্রমুখ ইংরেজ কবিদের কাব্যে। কবি হাফিজ তাঁর দেওয়ানের শুরুতেই বলেন,
الايا ايها الساقي ادر کأساً و ناولها
که عشق آسان نمود اول ولي افتاد مشکلها
সাকি ওগো ঢালো শরাব বিলাও সবায় ভর পেয়ালা
প্রেম যে আগে লাগল ভালো এখন কিন্তু ভীষণ জ্বালা।
কবি শেলী বলেন,
For love, beauty and delight
There is no death, nor change
রবার্ট সাদে (Southey) বলেন,
Love is indestructible.
এই প্রেমের আঘাতে যে জর্জরিত হয়েছে, সে সকল লোভ, লালসা ও অপবিত্রতার উর্দ্ধে উঠে গিয়েছে। তাই মাওলানা রুমি বলেছেন,
سينه خواهم شرحه شرحه از فراق
تا بگويم شرح درد اشتياق
‘বিরহ বেদনায় যাহাদের বক্ষ বিদীর্ণ,
আমার প্রেম—বেদনা প্রকাশের জন্য বক্ষেরই প্রয়োজন এমন চূর্ণ—বিচূর্ণ।
এ সব মহাপুরুষগণ যারা প্রেমামৃত পান করে ধন্য হন, স্থুল দৃষ্টির আড়ালে যে সূক্ষ্ম জগত বিদ্যমান, সে সত্যের শিখা অনির্বাণ জ্বলছে, তাঁদের অন্তদৃষ্টির সামনে সবই প্রতিভাত হয়। এক কণা বালুকা বা ধুলিকণার মধ্যে তারা বিশ্বরহস্যকে, একটি বন্য ফুলের মধ্যে তারা স্বর্গের সুষমাকে দেখতে পান। কবি ব্রেক বলেছেন,
To see a world in a grain of sand
A Heaven in a wild flower
Hold Infinity on the palm of your hand
An Eternity in an hour
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
এই তো তব প্রেম ওগো
হৃদয় হরণ,
ঐ যে পাতায় আলো নাচে
সোনার বরণ।
(গোলাম রসুল, ২০১৩: ১৩—১৭)
শরিয়ত ও সুফিবাদ—পারস্পরিক সম্পর্ক
ইসলামের অভ্যূদ্বয়ের সময় পৃথিবীর মানুষের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সভ্যতার অবস্থা অধঃপতিত ছিল। একত্ববাদের জ্যোতি তখন নক্ষত্রপূজা, মূর্তিপূজা, কাল্পনিক বস্তু, ধারণার পূজা এবং গণনাশাস্ত্রের বিশ্বগ্রাসী অন্ধকারে আবৃত ছিল। নৈতিক মূল্যবোধ তখন বিকৃত আবেগানুভূতি দ্বারা পদদলিত ছিল। বিশ্বের জাতিসমূহের পারস্পরিক বিবাদ—বিসম্বাদ, যুদ্ধ—বিগ্রহ ও বর্বরতার কারণে মানব জাতির ঐক্য ও সংহতি বিলুপ্ত হয়েছিল। তৎকালীন বিশ্বের প্রচলিত বড় বড় ধর্ম (হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও খ্রিষ্ট ধর্ম) ও বড় বড় সভ্যতা (ভারতীয় সভ্যতা, ইরানি সভ্যতা ও রোমান সভ্যতা) নির্জীব ও নিস্প্রাণ হয়ে পড়েছিল। তখনই নবুওয়াতের সূর্য উদিত হয় এবং সূফিবাদের আলো চতুর্দিক আলোকিত করতে থাকে।
সুফিবাদ ইসলামের মূল ভিত্তি। ইসলাম প্রথমে গ্রীক দর্শনের যাদুর জাল ছিন্ন করে। ইসলাম অগ্নি উপাসকদের দ্বিত্ববাদের অসারতা প্রমাণ করে। মুসলিম ইতিহাস—দর্শনবিদ ইব্ন খালদুন অবচেতন মনে অবস্থিত বিষয়াবলির আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিল এবং মুসলিম দার্শনিক ইব্ন সিনা মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা করেন। তাদের চিন্তাধারা শুধু মনোবিজ্ঞান চর্চায় নয়, বরং ধমীর্য় বিষয়াবলি ও সুফিবাদ—এর চর্চায় এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত করে। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ২০০৫: ৫৩১) সমাজ ও রাষ্টবিজ্ঞান বিষয়ক চিন্তাধারাকে গ্রীক চিন্তাবিদগণ যে স্তরে রেখেছিলেন, আল— ফারাবী ও ইব্ন খালদুন এর ন্যায় মুসলিম মনীষীগণের গবেষণা ও মতবাদসমূহ রাজনীতি, সমাজনীতি ও পৌর বিজ্ঞানে তা হতে উন্নততর স্তরে পৌছে দিয়েছেন। মানুষ তাসাউফ তথা সুফিবাদের দীক্ষা লাভ করে সমাজে ন্যায় পরায়নতা, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ফলে অমুসলিম সমাজ থেকেও রাজনৈতিক ও সামাজিক, জুলুম—অত্যাচার নিমূর্ল হয়েছে। যেমন— ইউরোপে ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের যে আন্দোলন জন্ম লাভ করেছে উহার পশ্চাতে ইসলাম ও সুফিবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সক্রিয় ছিল।
(ইসলামী বিশ্বকোষ, ২০০৫: ৫৩২)
কুরআন ও হাদীস অনুসারে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত এ বিধি বিধানসমূহ পরিপূর্ণভাবে মেনে চললে তাদেরকে শরিয়তের অনুসারী বলা হয়। শরিয়ত হলো সুফিবাদে যাত্রাপথের প্রথম পদক্ষেপ। তাসাউফ এবং শরিয়ত দুটি এমন বিষয় যে, একটিকে দেহের সাথে তুলনা করলে, অপরটিকে আত্মার সাথে তুলনা চলে। মাওলানা রুমি বলেছেন,
تن ز جان و جان ز تن مستور نيست
ليک کس را ديده جان دستور نيست
প্রান থেকে দেহ এবং দেহ থেকে প্রান লুকানো নয়।
কিন্তু কেউ প্রানকে দেখবে-এরূপ নিয়ম-বিধান নেই।
(রূমি, ১৩৭৩ শা : ২)
মাওলানা রুমি তাসাউফ তথা সফিবাদকে দেহের আগুনের সাথে তুলনা করে বলেছেন,
آتش است اين بانگ ناي نيست باد
هر که اين اتش ندارد نيست باد
বাশরির এ আওয়াজ আগুন, বাতাস নয়।
যার মধ্যে এ আগুন নেই, সে যেন ধ্বংশ হয়।
(রূমি, ১৩৭৩ শা : ২)
শরিয়তের বিধিবিধান অনুসরণের মাধ্যমে সাধকের শরীর ও হৃদয়ের উৎকর্ষের সাথে সাথে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। এ জন্যই শরিয়তকে আধ্যাত্মিক পথের প্রথম সিঁড়ি বলা হয়। শরিয়তের বিধানগুলো অনুসরণের মাধ্যমে একজন সুফি স্বীয় নফসকে দমন করে রূহ বা আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এ রূহ বা আত্মার বিকাশ সাধনের প্রথমপর্ব হচ্ছে শরিয়তের বিধানগুলো মেনে চলা এবং শরিয়ত বিরোধী কোন কাজ সম্পাদিত হলে তার জন্য অনুশোচনা ও তওবা করা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
অর্থ: হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কর্মগুলো মোচন করে দেবেন। এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত।
(তাহরিম—৬৬: আয়াত—৮)
শরিয়ত হলো একটি পন্থা বা দিক যা অবলম্বনের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। একজন সুফি সাধক যখন শরিয়তের বিধানসমূহ পরিপূর্ণভাবে পালন করেন তখন তার মধ্যে আত্মশুদ্ধি ঘটে। এতে সাধক লাভ করেন একধরনের আত্মোপলব্ধি। এই আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে সুফিসাধক যখন আল্লাহর এরূপ পথে অগ্রসর হন; যে পথ অত্যন্ত কঠিন, দুরুহ ও বন্ধুত্বের। তখন সাধকের জন্য কিছু পন্থা বা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। এ পন্থা বা পদ্ধতিগুলো শিক্ষা লাভের জন্য সাধক এমন এক ব্যক্তির স্মরণাপন্ন হন, যিনি সাধনাবলে পরম সত্ত্বাকে চিনতে পেরেছেন এবং তাঁর নৈকট্য অর্জন করেছেন। তিনি হচ্ছেন আহলে হাকিকত (গূঢ় জ্ঞানের অধিকারী) এবং তিনি হচ্ছেন সত্যিকারের ওয়ালী ও ইনসানে কামেল। (তামীমদারী, ২০০৭ : ১৯) এ ধরনের অলি— আল্লাহকে মুর্শিদ বলা হয়। তিনিই এ যাত্রা পথের অলি—গলি সম্পর্কে অবগত। পারস্যের সুফি সাধক শামসুদ্দিন মোহাম্মদ হাফিজ এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
به مي سجاده رنگين کن گرپير مغان گويد
که سالک بي خبر نبود ز راه و رسم منزل ها
জায়নামাজে শরাব রঙিন কর মুর্শেদ বলেন যদি,
পথ দেখায় যে, জানে সে যে, পথের কোথায় অন্ত—আদি
পথ দেখায় যে, জানে সে যে, পথের কোথায় অন্ত—আদি
(হাফিজ, ১৩৬২: ১)
دوش از مسجد ز ميخانه آمد پير ما
چيست ياران طريقت بعد از اين تدبير ما
গতরাত আমার মুর্শিদ মসজিদ থেকে মন্দিরে গেল
ওহে ত্বরিকতের বন্ধুগণ এসব প্রচেষ্ঠায় কি লাভ হবে!
করতে করতেই একটা পর্যায়ে এসে উল্লেখিত গুণাবলি সম্পন্ন কোন একজন মুর্শিদের স্মরণাপন্ন হন, যিনি তাঁর শিষ্যকে আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধি লাভের নিমিত্ত বুদ্ধি পরামর্শ প্রদান করে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন। (শিব প্রসাদ শূর, ২০০৯ : ১৭) তাসাউফ বা সূফিবাদ সম্পর্কে কিছু মানুষের ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে। তারা মনে করেন শরিয়ত ও সুফিবাদ একটি অপরটির বিপরীতমুখী। তাদের ধারনা তরীকত শরিয়ত থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন সাধন প্রণালী। বরং শরিয়ত ও সুফিবাদ পরস্পর সম্পর্কিত একটি সাধন প্রণালি। এদের একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করার কোন সুযোগ নেই। শরিয়তের উচ্চতম সাধনায় নফসের এসলাহ বা আত্মসংশোধনের মধ্য দিয়ে আত্মার উন্নয়ন সম্ভবপর হয়ে ওঠে। (শিব প্রসাদ শূর, ২০০৯ : ১৭) অতএব সুফিবাদ শরিয়তেরই অন্তভূর্ক্ত একটি বিষয়। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্ধার উপর আরোপিত নির্দেশ সমূহের সমষ্টির নাম হচ্ছে শরিয়ত। শরীয়তে জাহেরী (প্রকাশ্য) এবং বাতেনী (গুপ্ত) যাবতীয় আমলসমূহ একইভাবে অন্তভূর্ক্ত। অথচ কোন কোন চিন্তাবিদ জাহেরী আমলসমূহকে শরিয়তের এবং বাতেনী আমলসমূহকে তাসাউফ বা সুফিবাদের অন্তভূর্ক্ত বলে মনে করেন। অবশ্য প্রকৃত সত্য হচ্ছে শরিয়তকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে তা চর্চার মাধ্যমেই আত্মোন্নয়ন সম্ভবপর হয় এবং সুফিসাধনার স্তরে উন্নীত হওয়া যায়। (শিব প্রসাদ শূর, ২০০৯ : ১৭)
শরিয়তের বিধিবিধান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমেই প্রচার—প্রসার লাভ করে। তাঁর ওফাতের পর তাঁর জীবদ্দশায় আচরিক সূক্ষ্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক ধ্যান—ধারণা ও জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন নবিজীর জামাতা হ্জরত আলী (রা.)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার গূঢ়তত্ত্বসমূহ হজরত আলী (রা.)—ই সরাসরি লাভ করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই এ তত্ত্ব মহান সুফিসাধক হজরত হাসান বসরী (র.) এর কাছে পৌঁছে। তিনি নবিজির বিবিগণের সান্নিধ্য, স্নেহ ও ভালবাসা অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশে সুফি সাধকগণের মাধ্যমে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। তাঁরা ব্যক্তিচরিত্রের ওপর ভিত্তি করে ত্যাগ ও সংযম এবং খোদাপ্রেমের মাধ্যমে একত্ববাদ, মমত্ববোধ ও আত্মশুদ্ধির প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। অধিকাংশ সুফি—সাধকগণ আরাবিস্তান ও ইরান থেকে বাংলাদেশে আগমণ করেছিলেন। তাঁরা মানুষের মধ্যে তাসাউফ তথা সুফিবাদ—এর মূল তত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছেন যাকে ইসলামের মূল ভিত্তি বলা চলে। যারা নিজ ইচ্ছা—অনিচ্ছার দ্বারা বা নিজ স্বার্ধবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত না হয়ে তাদের সমস্ত কামনা—বাসনা, আশা—আকাঙ্খা মহান আল্লাহর সন্তোষ বিধানের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতেন এবং নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতেন, তাঁরা সুফিদের পরিভাষায় ‘ফানা’র স্তরে পৌছে যেতেন।
এই ফানা আত্মবিলুপ্তি নয় বরং আত্মোন্নয়ন (Infinite expansion of the ego)। ডক্টর ইকবালের ভাষায়— ‘Realization of the human ego in a profounder personality’— এই ফানার স্তরে সাধক পৌঁছলে—তাঁর নিজ অস্তিত্ব বা সত্তা বিলুপ্ত না হয়ে আল্লাহর সমীপে তিনি নিবেদিত চিত্ত হন, তাঁর আমিত্ব— অহংকার উৎসর্গ করে তিনি আল্লাহর অসীমত্বের আস্বাদ পান। তিনি যেন নিজের কাছে মৃত্যুবরণ করে স্রষ্টার মধ্যে বেঁচে থাকেন।
এ ফানার অবস্থার পরের স্তর হলো সুফিদের ভাষায় ‘বাকা’। অর্থাৎ নিজ ক্ষুদ্রত্বকে বিসর্জন দিয়ে সাধক তখন মরত্বের স্তরে উন্নীত হন। ইমাম গাজ্জালী বলেন, তার সামনে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্তাই দৃষ্টিগোচন হয় না। তখন তার নিজের ইচ্ছা, নিজ স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না। তিনি একান্তভাবে আল্লাহর কাছে সব কিছুই বিলিয়ে দেন। যেহেতু তার জীবন—মরণ, সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় সমর্পিত হয়, আল্লাহই হন তার সর্ব শক্তি ও প্রেরণার উৎস। (গোলাম রসুল, ২০১৩ : ১৮)
এ অবস্থায় পৌছে ছিলেন মনসুর হাল্লাজ, বায়েজিদ বোস্তামী, হাফেজ, রুমিসহ বহু ব্যক্তিবর্গ, যাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। মনসুর হাল্লাজ ফানা ফিল্লাহর পর্যায় পৌছে انت الحق (আপনি সত্য) এর পরিবর্তে উচ্চারণ করলেন, انا الحق (আমি সত্য), অনুরূপ হজরত বায়েজীদ سبحانک আপনি পবিত্র— এর পরিবর্তে উচ্চারণ করলেন, سبحاني আমি পবিত্র।
ফানা ফিল্লাহর পর্যায় পৌঁছলে যখন আত্মবিলোপ ঘটে, তখন মনে হয় পরম সৌন্দর্যময় আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছা গেছে। যে নূরের সামান্য ঝলকে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম বেহুশ হয়েছিলেন। মাওলানা রুমি এ প্রসঙ্গে বলেন:
جسم خاک از عشق بر افلاک شد
کوه در رقص آمد و چالاک شد
عشق جان طور آمد عاشقا
طور مست و خر موسي صاعقا
মাটির দেহ প্রেমের কারণে ঊর্ধাকাশ পাড়ি দিল
পর্বত নেচে উঠল ও প্রাণ চঞ্চল হল।
ওহে প্রেমিক! প্রেম যখন তুর পাহাড়ে প্রাণ সঞ্চার করল,
তুর উন্মাতাল, আর মুছা মুর্ছিত হয়ে পড়ে গেল।
(রূমি, ১৩৭৩ : ৫)
পারস্যের সুফি সাধক হাফেজ বলেছেন:
اگر آن ترک شيرازي به دست آرد دل مارا
بخال هندويش بخشم سمرقند و بخارا را
দেয় যদি ঐ তুকীর্ প্রিয়া আমার প্রেমের প্রতিদান
করব কবুল তার তিলের লাগি সমরকন্দ আর বুখারা দান।
بده ساقي مي باقي که در جنت نخواهي يافت
کنار آب رکناباد و گلگشت مصلا را
সাকি অবমিষ্ট শরাবটুকুও আমাকে দাও। কারণ স্রোতঃস্বিনী স্বতির তীর ও মুসল্লার মত
স্বচ্ছ—সোভা ও মনোলোভা পরিবেশ বেহেশে্তও পাওয়া যাবে না।
(হাফেজ, ১৩৬২ : ২)
সুফিদের ধর্ম প্রেম ধর্ম উল্লেখ করে হাফিজ বলেছেন:
ملت عشق از همه ملت جداست
عاشقان را مذهب و ملت خداست
প্রেমের ধর্ম সকল ধর্ম থেকে আলাদা
প্রেমিকগণ হলেন খোদার ধর্ম ও মাযহাব।
সুফিগণ বলেছেন :
نه من حنفي، نه من شافعي، نه من هذهب حنبلي دارم
مالي هم نه ماند مگر مذهب عشقي دارم
আমি হানাফি, শাফেয়ী, হাম্বলি
এবং মালেকী মাযহাবের নই,
আমি প্রেম মাযহাবের অনুসারী
সুফি সাধক শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার মানতেকুত তায়ের তথা পাখিদের সংলাপ শীর্ষক আলোচনার মাধ্যমে সী—মোরগের সন্ধানে মহান সুষ্টিকর্তার সাথে একাত্ম হওয়ার অত্যন্ত সুন্দর উপমা ব্যক্ত করেছেন। বরকতুল্লাহ অত্র গল্পটি বর্ণনায় লিখেছেন :
ত্রয়োদশ প্রকাশ বিহঙ্গম একত্রিত হইয়া যুক্তি করিল, তাহারা পরাবৃত্তের প্রসিদ্ধ পাখি সী—মোরগের সন্দর্শনে যাত্রা করিবে। কল্প লোকের কোন্ মহিমান্বিত রাজ্যে উহার বসতি লোকের কোন মহিমান্বিত রাজ্যে উহার বসতি তাহা কেহ জানে না। উহার কোন্ কলাপের ছায়া সমপাতে ইন্দ্রধনুর বঙ্কিম চূড়া মেঘলোকে রাঙ্গিয়া উঠে, তাহার মীমাংসার নাকি আজও চীনদেশের চিত্রকরেরা বিব্রত। যাত্রিরদল হুদহুদ নামক প্রসিদ্ধ পাখীর নেতৃত্বে এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় কৃত সংকল্প হইল। দৌত্যকার্যে এই হুদহুদের খ্যাতি প্রাচীন কাহিনীতে সুপ্রসিদ্ধ। কথিত আছে সাফা শহরের রাজ্ঞী বিলকিসের নিকট বাদশাহ সোলায়মানের প্রণয়বার্তা বহন করিতে এই হুদহুদই একদা ইমেন দেশে প্রেরিত হইয়াছিল। (বরকতুল্লাহ, ১৯৬৪ : ১৭৯)
তাসাউফ শব্দটির জন্ম আমাদের প্রিয় নবি হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন কাল থেকে। কোন কোন গবেষক মনে করেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে اصحاب صفا আসহাবে সোপ্পা নামে একটি দল ছিলেন, যাদের ঘর—বাড়ি ছিল না। তারা সর্বদা প্রিয় নবির সান্নিধ্যে থাকতেন। এই اصحاب صفا (আসহাবে সোপ্পা) থেকে সুফি শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতও রয়েছে।
তাসাউফ হচ্ছে সকল আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার সমষ্টি। এর মূল কথা হচ্ছে, মহান আল্লাহ পরম সৌন্দর্যময়। الله نور السموات والارض ‘সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবীর আলোই আল্লাহ। সে মহান সৌন্দয্যের সান্নিধ্য লাভ করতে হলে নিজেকে সৌন্দর্যের পবিত্রতায় মন্ডিত করতে হবে। তবেই অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। সেখানে পৌঁছতে তাসাউফ তথা সুফিবাদের দীক্ষার প্রয়োজন।
গ্রীক দর্শন এবং প্রাচীন ইরানিয় দর্শনের যে আধ্যাত্মবাদ ইসলাম পূর্বযুগে শুরু হয়েছিল তারই একটি রেশ প্রবল হয়ে উঠে পারস্যে ৫ম থেকে ৬ষ্ট শতাব্দীর প্রথম দিকে। অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের আগে। তারই একটি পরিবর্তিত রূপ অর্থাৎ প্রথম আবু সাঈদ আবিল খায়ের হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে (খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দী) সামা’র প্রচলন করেন। (তামীমদারী, ২০০৭ : ২০) হজরত ইমাম গাজ্জালীর মতে, শরীয়তে সামা’র ও নৃত্যের অনুমতি নেই। তাই তারা সামা’র অনুমতি দিতেন না। কিন্তু মাওলানা জালালউদ্দিন রুমিসহ বিভিন্ন আলেমগণের নিকট সামা’ বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ছিল।
শরিয়তপন্থীদের অনুরূপ সুফিসাধকগণও জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধের পক্ষপাতি তবে সুফি সাধকগণের জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ কোন বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে নয়, বরং আত্মস্থিত কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধেই তাঁদের প্রধান এবং একমাত্র সংগ্রাম। সুফি সাধকগণ রুহ বা আত্মার উন্নতি সাধক করে থাকেন। কেননা নফস হচ্ছে মানুষের কামনা, বাসনা এবং লোভ—লালসা। রুহের আবির্ভাব হয়েছে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এবং নফসের উপর আধিপত্য হচ্ছে শয়তানের; সেহেতু রুহ বা আত্মার উন্নতি সাধন করতে হবে এবং নফসকে সংবরণ করতে হবে তবেই জীবনে সিদ্ধিলাভ সম্ভব। সুফিসাধকগণ সর্বদা এ কাজটিই করে থাকেন।
শরিয়ত ও তাসাউফ ভিত্তিক কাব্য সাহিত্য
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফি দরবেশগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ সুফি মতবাদের প্রভাবে গড়ে উঠেছে। সাহিত্যের এ ধারাটিকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়; আধ্যাত্মিকতাবাদের তত্ত্ব ও তার অনুশীলনের দার্শনিক ব্যাখ্যা এবং ঐতিহ্যগত সঙ্গীতাবলি।
সঙ্গীতগুলো পদাবলি হিসেবে পরিচিত এবং এ ধারা প্রধানত বাউল ও মুর্শিদি গাণের সমন্বয়ে গঠিত। এতে শিষ্যের আত্মবিনাশ ও দিব্যজ্যোতি লাভের জন্য অতিক্রমনীয় পর্যায়সমূহের বিস্তারিত বিবরণ আছে। হাজী মোহাম্মদ এবং সৈয়দ সুলতান এ ধারার লেখকদের মধ্যে প্রধান। হাজী মোহাম্মদের নূর জামাল কাব্য, সৈয়দ সুলতানের জনন প্রদীপ-এর চেয়ে অধিকতর দার্শনিক তত্ত্বসমৃদ্ধ। তিনি পাঠকদের প্রথমে শরিয়তের কথা বলেন, অতঃপর ওহাদাতুল ওজুদ ও সর্বেশ্বরবাদ সম্পর্কে বহুমূখী দার্শনিক তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করান। এ ছাড়া ও তিনি ইবনুল আরাবী এবং মোজাদ্দেসে আলফে ছানি (র.) এর বিভিন্ন মতবাদ ও বর্ণনা করেন। জনপ্রিয় মূর্শিদি ও বাউল গানগুলি গভীর দার্শনিক তত্ত্বে ভরপুর। বাংলায় প্রাপ্ত অধিকাংশ মুর্শিদি গান ইরানি কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমীর মাসনাভী এবং শেখ ফরিদউদ্দিন আত্তারের মানতেকুত ত্বায়ের এর প্রভাবে প্রভাবিত।
(বাংলা পিডিয়া, পৃ. ১৪১—১৪২)
চট্টগ্রামের সৈয়দ সুলতান নবি বংশ কাব্যে রসূলের জীবনের সূচনা থেকে শুরু করে তাঁর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের কারবালায় শাহাদাতবরণ করা পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। পূর্বে মুহাম্মাদ খানও মাকতুলে হোসেন শিরোনামে একটি কাব্য রচনা করেন। ইমাম হোসেনের শাহাদাতের ঘটনা এ গ্রন্থের মূল বিষয়। কায়কোবাদের মোহাররম শরীফ এ ধারার প্রাচীনতম গ্রন্থ। ইমাম হোসেনের শাহাদাতকে কেন্দ্র করে এতে একটি মর্সিয়া স্থান পেয়েছে।
খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতক ছিল শরিয়ত ও তাসাউফমূলক কাব্য ধারার সম্প্রসারণের যুগ। এ সময়ের অনেক কবিই বিশ্বসৃষ্টি, মহানবি হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী ও ইসলামের শরিয়াতী বিধিবিধান বর্ণনা দিয়েছেন। প্রথিতযশা সাহিত্যিক মোজাম্মেল এ ধারার প্রাচীনতম লেখক। তাঁর কাব্য নীতি শাস্ত্রের বিভিন্ন বিধি—বিধানের বর্ণনায় সমৃদ্ধ। কবি আফজাল আলী মঙ্গলকাব্যের অনুসরণে ইসলামি শরিয়তী বিধি—বিধানের বিশদ বিবরণ সম্বলিত নসিহতনামা রচনা করেন। এতে তিনি স্বপ্নে তাঁর পির শাহ রোস্তম কিভাবে তাঁর নিকট আবিভূর্ত হয়ে নির্দেশনা প্রদান করতেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। সৈয়দ সুলতানের নবি বংশ, শাবে মিরাজ, ওফাতে রসুল ও মোহাম্মদ খানের মাকতুলে হোসেন এবং কিয়ামত নামায় বিশ্বসৃষ্টি, বিবর্তন ও কিয়ামত ইত্যাদি বিষয় বর্ণনা করেছেন।
নসরুল্লাহ খান (১৫৬০—১৬২৫) তাঁর শরিয়তনামায় আল্লাহর নির্দেশাবলির কথা বলেছেন এবং আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘনকারীদের সতর্ক করেছেন। এটা স্পষ্ট যে, নসরুল্লাহ খান এ গ্রন্থটি মুসলমানদেরকে তাদের ধমীর্য় বিধানাবলি সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যেই রচনা করেছেন। অনুরূপভাবে শেখ মোত্তালিব তাঁর কিফায়াতুল মোসলেমিন গ্রন্থে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও ইসলামের অন্যান্য শরিয়তী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। (বাংলা পিডিয়া, পৃ. ১৪১)
উপসংহার
শরিয়তের উপর ভর করে সুফিসাধনায় অগ্রসর হতে হয়। সুফিসাধক জীবনের সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরশীল থাকেন। তাঁরা সর্বদা সৎকর্ম সম্পাদন করেন এবং অসৎ কর্ম থেকে বিরত থাকেন। প্রখ্যাত সুফিসাধক শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী বলেন, ‘কোনও ব্যক্তির যে কোনও কাজ কর্মে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন হচ্ছে তাওয়াক্কুল বা নির্ভরশীলতা। (শিব প্রসাদ শূর, ২০০৯ : ১৮) শরিয়ত ও তাসাউফ একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু একটি মহল নিজেদের কুপ্রবৃত্তির প্রভাবে এ দুটিকে পৃথক ও আলাদা করার প্রচেষ্ঠা চালাচ্ছেন। তারা প্রচার করেন, সুফিবাদের কেন্দ্র মাইজভাণ্ডারে গমণ করলে নামায, রোযা, কুরআন তেলাওয়াতের প্রয়োজন পড়ে না; পিরই সকল সমস্যার সমাধান করে দেন। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের আবেগ—প্রবণতাকে পূজি করে অলস, নিস্কর্ম, কুমতলবের এ ধরনের কিছু মানুষ এ পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে নিজেদের সূক্ষ্ম প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে এ কল্পিত ও বানোয়াট ধারনাকে ফুলে ফলে পল্লবিত করে তা প্রকাশ করতে থাকেন। (তাসাউফ, ২০১৬ : ১৮২) প্রকৃত পক্ষে পবিত্র ইসলাম ধর্মের শরিয়তী বিধিবিধান যথার্থভাবে মেনে মানসিক উৎকর্ষতার পর্যায়ে তরিকতের সূক্ষ্ম কর্মকাণ্ডে প্রবেশ এবং মারফতের উচ্চতর স্তরে উত্তরনের অবিরত প্রক্রিয়ায় মাইজভাণ্ডারী পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে ইনসানে কামেলে উন্নীত হয়ে মহান আল্লাহর সাথে মিলনের চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছা সম্ভব। শরিয়ত ও সুফিবাদের আলোচনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও গভীর। এ বিষয়ের আলোচনা যেন সমুদের পানির কাছে ধারনকৃত পেয়ালার পানির সমতুল্য; যেমন মাওলানা রুমির ভাষায় :
گر بريزي بحر را در کوزه اي
چند گنجد؟ قسمت يک روزه اي
সমুদ্রকে যদি একটি পিয়ালায় ঢাল,
তবে কতটুকুর সংকুলান হবে?
একদিন ব্যবহারের পরিমাণ (অধিক নহে)।
কৃত: ড. মো. নূরে আলম
সহযোগী অধ্যাপক
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।