Skip to content Skip to footer

বিজ্ঞান ও সুফিদের ভাবনা

সুফিরা যে জগতে ডুবে থাকেন এবং স্রষ্টার সাথে তাঁদের যেভাবে যোগাযোগ হয়, তার মাধ্যমে তাঁরা সত্যে উপনীত হন। আর আমরা বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা—নিরীক্ষা, নানান রকম যাচাই—বাছাই করে, এখানে ওখানে, লন্ডনে, দিল্লিতে, মস্কোতে একই জিনিস পরখ করে তারপর একটা সত্যে উপনীত হই।

অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার যে, বহুক্ষেত্রে আমরা বিজ্ঞানীরা যে সত্যে উপনীত হই, সুফিরা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে সেই একই সত্যে উপনীত হন। এ বিষয়ে অনেকগুলো উদাহারণ অত্যন্ত সহজ করে বলার চেষ্টা করব। ইতোপূর্বে আমার এই নিবন্ধটি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে উপস্থাপন করার সুযোগ হয়েছিল।

যেকোন বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্যে সায়েন্সের একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। কিন্তু তারপরও এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আমরা সকল সত্যে উপনীত হতে পারি। এই বিজ্ঞান বা সায়েন্সের পথ এবং সুফিদের পথ কিন্তু আলাদা, এক নয়। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো বিষয়ে বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান আর একই বিষয়ে সুফিদের এবং তাঁদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত কবি ও দার্শনিকদের চিন্তা চেতনাও অনেক ক্ষেত্রে একই উপসংহারে এসে পৌঁছায়।

প্রখ্যাত সুফি শেখ সাদি সোহরাউয়ার্দির জীবনী দেখুন। আমরা মিলাদ পড়ি, ওখানে আবৃত্তি করি, বালাগাল উলা বে কামালিহী, কাশাফাদ্দুজা বে জামালিহী, হাসনাত জামিও খেছালিহী— তারপরে তিনি আর মেলাতে পারছিলেন না, কিছু আসছিল না তাঁর চিন্তায়। খেই হারিয়ে ফেলে ঘুমিয়ে গেলেন। স্বপ্নে আমাদের প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আদিষ্ট হলেন যে, বলো— সাল্লূ আলাইহে ওয়ালিহী। এই বাক্যের চেয়ে ভালো মিল আর হয় না।

শেখ সাদি রহমাতুল্লাহি আলাইহি আরও লিখেছেন—

বার্গে দারাখতানে সবজ
দার নাজারে হোঁশিয়ার
হার ওরাকে দাফতারিসত
মারেফাতে কারদেগার।

শব্দগুলো ফার্সি। এই শব্দগুলো বাংলা করলে দাঁড়ায়—দারাখতনে সবজ মান সবুজ গাছ, হোঁশিয়ার মানে সচেতন, নজর মানে দৃষ্টি, ওরাক মানে পাতা, দফতর মানে দলিল বা নথিপত্র আরা মারেফাত হলো জ্ঞানের একটি বিশেষ ধারা, কারদেগার মানে কারিগর বা স্রষ্টা। এর অর্থ করলে দাঁড়ায়— একজন সচেতন ব্যক্তির দৃষ্টি যদি সবুজ গাছের পাতায় পড়ে, তাহলে সেই পাতার মধ্যে দেখতে পাবে তার কারিগরের গুপ্তধনের দলিল অর্থাৎ জ্ঞান বা মারেফাত।

এ কথা যখন তিনি লিখেছিলেন তখন কিন্তু ফটোসিনথেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ কী, বিজ্ঞানীদের তা জানা ছিল না। কিন্তু আজকে আমরা জানি, একটা গাছ মাটি থেকে কিছু রস আর পানি নিয়ে, বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ করে নিজের খাদ্য তৈরি করে। তার নিজের প্রয়োজনে সামান্য একটু অংশ রেখে বাকিটুকু সে ধরে রাখে মানবজাতির জন্যে।

এই যে তেল কয়লা কাঠ, যা কিছু আছে, আমাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সব আসে এই উদ্ভিদ থেকে। এবং উদ্ভিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো পাতার সবুজ অংশে ক্লোরোফিল। শেখ সাদি বলেছেন, সেই পাতার মধ্যে নিহিত আছে সমস্ত রহস্য। যদিও আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স অব ফটোসিনথেসিস সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারেননি। তাঁরা এখনও উদ্ধার করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, কীভাবে বৃক্ষ এ কাজটা করে। এরপরও বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যেটুকু জানতে পারলেন, শেখ সাদি কিভাবে তারও আগে সেই সত্য বলে গেলেন, সেটা ভাবতে অবাক লাগে। ওমর খৈয়ামের প্রসঙ্গ আসি। পাশ্চাত্যের ধারণা অনুসারে, ওমর খৈয়াম হচ্ছেন মদভর্তি গ্লাস হাতে একজন মাতাল। কিন্তু ওমর খৈয়াম যে সুরার কথা বলেছেন, তা এই সুরা নয়। তিনি যে ভালোবাসার কথা বলেছেন, যে আসক্তির কথা বলেছেন, সেটা অন্য আসক্তি। ইন্দ্রিয় আসক্তি নয়।

তিনি ছিলেন একজন বড় গণিতজ্ঞ। তাকে বলা হয় ‘ফাদার অব দ্য কিউবিক ইকুয়েশন’। একজন গণিতজ্ঞ হিসেবে কয়েক বছর আগে ইউনেস্কো তাঁর জন্মদিন পালন করল। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন— মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই। ঠিক সেইরকম ওমর খৈয়াম চাইতেন, তিনি যেন সেজদারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এবং তা ই হয়েছিল। তাঁর আরেকটা ইচ্ছা ছিল, এমন একটা গাছের তলায় যেন তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়, যেখানে গাছের পাতাগুলো পড়ে তাঁর কবরটা সবসময় আচ্ছনান থাকবে।

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন প্রথম ইরানের নিশাপুর সফরে যাই, অবাক হয়ে গেলাম—ঠিক যেভাবে তিনি কল্পনা করেছেন, গাছের নিচে যেভাবে তাঁকে শুইয়ে রাখার ইচ্ছা করেছিলেন, ওমর খৈয়াম ঠিক সেভাবে শায়িত আছেন ওখানে। এটা ছিল এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি থেকে অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষা। খৈয়াম লিখেছেন—

The Moving finger writes, and having writ,
Moves on: not all your piety nor wit
shall write it back to cancel half a line
nor all your tears wash out a word of it

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, সাত সাগর যদি কালি হয় এবং পৃথিবীর সকল গাছ যদি কলমে রুপান্তরিত হয়,তবু স্রষ্টার প্রশংসার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। ওমর খৈয়াম রুবাইয়াৎ— এ বলেছেন, যতই কাঁদো, এর একটি অক্ষরও তোমার চোখের পানিতে মুছে যাবে না, পরিবর্তন হবে না । বিজ্ঞানীরা এ কথাটি বললেন এনট্রপি ইন থার্মোডায়ানামিকস—এ। একজন সুফির অন্তর্দৃষ্টি থেকে তিনি যা বলেছিলেন রুবাইয়াৎ—এ, বিজ্ঞানীরা ১৯৭৮ সালে এসে বললেন যে, এটা থার্মোডায়ানামিক প্রিন্সিপাল— এর সাথে দারুণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।[ফিয়ারস, ভার্জিল মর্নিং ও সিমমানগ, ক্লিফর্ড ম্যাক্স, ‘‘থার্মোডাইনামিকস’’ (৬ষ্ঠ সংস্করণ), ৫ম অধ্যায়— দ্বিতীয় সূত্র, ম্যাক মিলান পাবলিশিং কোং, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৮] এখানে যে কথাটি বলতে চাচ্ছি সেটি হলো, ওমর খৈয়ামকে বিজ্ঞানীরা উদ্ধৃত করেছেন।

এবার আসি হাতিফ ইস্পাহানির প্রসঙ্গে। তিনি ছিলেন হিজরি ১১ শতকের একজন সুফিসাধক। তার ওপর বই খুঁজতে গিয়ে আমি তেহরানের অনেক লাইব্রেরি চষে ফেলেছি, অনেক অপেক্ষার পর বইটি এক জায়গায় পেয়ে যাই। তিনি লিখেছেন, ‘‘দেলে হার জাররাই কেহ বেশকাফি আফতাবিশ দারমিয়ান বিনি’’। দেলে মানে দিল, হার মানে প্রত্যেক বা আমরা যে হরহামেশা বলি, তা। জাররা মানে খুব ছোট্ট (অণু পরমাণু), আর আফতাব হলো সূর্য।

অর্থাৎ যদি তুমি প্রতিটি ক্ষুদ্র বস্তুর গভীরে প্রবেশ করো এবং আঘাত করো, তাহলে তার কেন্দ্রবিন্দুতে একটা সূর্য দেখতে পাবে। কী অদ্ভুদ কথা! এখন আমরা জানি যে, যেকোনো বস্তু বা পদার্থের এটমের ভিতরে আছে নিউক্লিয়াস, বাইরে ইলেকট্রনগুলো। সৌরজগতের গ্রহগুলো যেরকম সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, প্রতিটি এটমের মধ্যে ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে। আর ওই নিউক্লিয়াসের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে সমস্ত শক্তি। এমনকি, লতিফায়ে খলার আবিষ্কার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণ করেছে যে, আমাদের দেহ রাজ্যের ভেতর অণু পরমাণুর মাঝে খলার (শূন্য) মহাজগৎ রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক হামলার মধ্য দিয়ে যে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ হলো, তার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। তিনি খুব বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে আমি যখন ইতালির ট্রিয়েস্টেতে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স—এ পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করছিলাম, তখন খুব অল্প বয়সে আমাকে ওখানকার এসোসিয়েট মেম্বার করা হয়। এর ফলে একবছর অন্তর অন্তর তিন মাসের জন্যে আমার ওখানে গিয়ে কাজ ও গবেষণার সুযোগ মেলে। যে কমিটির মাধ্যমে আমাকে ওখানকার এসোসিয়েট মেম্বার নির্বাচন করেছিল, সেই কমিটির এসোসিয়েট মেম্বার নির্বাচনের বিচারক মন্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার।

যাই হোক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কেউ তাঁকে নাকি আর হাসতে দেখেনি। কারণ তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি যে, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে যে এটম বোমাগুলো ফেলা হচ্ছিল, সেগুলোর ধবংসক্ষমতা এতটা হবে। আমেরিকা মনে করছিল, জার্মানরা এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্যে এটম বোমার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করছিল। তাই বোমা ফেলার আগে এ নিয়ে কোনো এক্সপেরিমেন্ট করা হয়নি। এক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটে তা হলো, একটা নিউট্রন নিয়ে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে আঘাত করে। ওটা ভেঙে দুটো অংশ হয়, কয়েকটা নিউট্রন বের হয়। তারপর একটা নিউট্রন আবার আরেকটা নিউক্লিয়াসে গিয়ে আঘাত করে, আবার দুটো অংশ হয়। আবারো দু—তিনটি নিউট্রন বেরিয়ে আসে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ফিশন (Fission), এভাবে তিনটি ফিশন হওয়ার পর এক প্রচন্ড শক্তি তৈরি হয়—প্রায় দু’শ মিলিয়ন ইলেকট্রনিক ভোল্ট। এ যে কী পরিমাণ শক্তি সেটা বুঝাতে গিয়ে পরমাণু বিজ্ঞানী রবার্ট জুঙ্ক একটি বই লিখেছেন। [জুঙ্ক রবার্ট—ব্রাইটার দ্যান অ্যা থাউজেন্ডস সানস, হারকোর্ট ব্রেস অ্যান্ড কোং, ১৯৫৮] এ থেকে বুঝা যায় যে, পদার্থের ভিতরের শক্তিটা কী বিরাট শক্তি হতে পারে! বইটা পরে বাংলা একাডেমি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। এখন চিন্তা করুন, এ বিষয়গুলো বিজ্ঞানেরও বুঝে ওঠার কয়েক শ—বছর আগেই হাতিফ ইস্পাহানি কী করে বললেন যে, প্রত্যেকটা বস্তুর ভেতরে যদি তুমি আঘাত করো, তবে তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে একটা সূর্য!

হিজরি ১১ শতকে অণু পরমাণুর কোনো ধারণাই মানুষের ছিল না। ১৯১২ সালের আগে নিউক্লিয়াসের মধ্যে কী আছে, সেটিও বোঝা যায়নি। অথচ কী নিখুঁত কথা তিনি বলে গেলেন! পরবর্তীতে গবেষণায় আমরা তা দেখতে পেলাম। এ জন্যেই আমি লিখেছি, ‘‘Compare this with the release of fission energy from the nucleus of the uranium atom. Most of the energy of an atom is locked up it its nucleus which may be considered as the heart of the atom.”

এরপরে দেখুন মাওলানা রুমির ধ্যানের পদ্ধতি, যেখানে বিশেষ হাল ও জজবায়ে দরবেশরা ঘূর্ণন করেন। রুমির কবিতা পাশ্চাত্যের তরুণদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। কারণ তাঁর কবিতায় রোমান্টিসিজম যেমন আছে, তেমনি আছে গভীর আধ্যাত্মিকতা। এক গভীর ভাব রয়েছে তার কবিতার মধ্যে। তুরস্ক, তাজিকিস্তানে গেলে মাওলাভিয়া তরিকার এই দরবেশদের দেখতে পাওয়া যায়। আমি ওখানে তাঁদের দেখেছি।

এ দরবেশরা বিশেষ হালে যেভাবে ঘুরেন, তা দেখলে মনে পড়ে যাবে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কথা। অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যের চারদিকে যেভাবে এন্টিক্লক-ওয়াইজ (ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে) ঘোরে, তাঁরাও সেভাবে বাম থেকে ডানে ঘোরেন। হজ্জের সময় হাজরে আসওয়াদকে হাতের বাঁয়ে রেখেও আমরা কিন্তু এন্টিক্লক— ওয়াইজ তাওয়াফ করি। ক্লক—ওয়াইজ ঘুরলে কী হতো? এন্টিক্লক—ওয়াইজ কেন ঘুরছি? আমরা কি এটা ভেবে দেখেছি কখনো? আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি। তারা বলেছেন, তারা ভেবে দেখেননি। আমরা এন্টিক্লক—ওয়াইজ ঘুরছি প্রকৃতির ছন্দে নিজেকে ছন্দায়িত করার জন্যে। কারণ যে গ্রহে আমাদের বসবাস, সেই গ্রহে অর্থাৎ পৃথিবী সূর্যের চারপাশে এন্টিক্লক—ওয়াইজ ঘুরছে। ইসলাম ফিতরাত বা প্রকৃতির ধর্ম। আর আমাদের সকল হিসাবনিকাশ এই পৃথিবীকে ঘিরে। যেমন ধরুন, সময়। পৃথিবী তার নিজস্ব কক্ষপথে চারপাশে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ২৪ ঘন্টা। আর সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসতে লাগে ৩৬৫ দিন। তাহলে সময়—আমি যে গ্রহে বাস করি, সে গ্রহের ঘূর্ণনের সঙ্গে সংযুক্ত; সেভাবেই আমাদের সময়টা নির্ণয় করি। আবার আমরা কোনো জিনিসের দৈর্ঘ্য মাপি—এক মিটার বা দুই মিটার সে দৈর্ঘ্যটাও পৃথিবীর ২৫ হাজার মাইল দৈর্ঘ্যের একটা অংশমাত্র। এছাড়াও আমরা যে ভর দেখি কোনো জিনিস কত ভারী তার ওজন মাপি, সেটাও পৃথিবীর সমস্ত ভরের একটা ক্ষুদ্র অংশ। অর্থাৎ মৌলিক বিষয় হলো ভর, দৈর্ঘ্য এবং সময়। এ তিনটি দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু বিবেচনা করা যায়। অর্থাৎ যে পৃথিবীতে, যে প্রকৃতিতে আমরা বাস করি, আমরা এর বাইরের নই। এর সাথে খাপ খাইয়েই আমাদের চলতে হবে। এটাই প্রকৃতিসম্মত এবং ইসলামসম্মত। যে কারণে কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,

“নিশ্চয় আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন রাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে, বসে বা শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হয় এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করো নি।” [আল কুরআন, সূরা আলে ইমরান (৩:১৯০—১৯১)]

দেখা যায়, একেকটি ঋতুতে যে জায়গায় যে জিনিস পাওয়া যায়, সার্বিকভাবে সেখানকার মানুষের ভালোর জন্যেই এর ফলন হয়। যেমন, এখন গবেষকরা দেখছেন, মার্চ—এপ্রিল মাসে ঋতু পরিবর্তনের সময় চিকেন—পক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, সজনে ডাঁটার মধ্যে আছে তার প্রতিষেধক। শুধু তাই নয়, যে দেশে যে ফল হয় কিংবা যে মাছ থাকে, তা সেই এলাকার মানুষের জন্যেই সবচেয়ে বেশি উপকারী। অন্য এলাকার বা দেশের জন্যে সেটার প্রয়োজন অতটা বেশি নয় আমাদের দেশে একটা সময় আফ্রিকান মাগুর আমদানি হলো, চাষ করা হলো। কিন্তু পরে বোঝা গেল যে, দেশি মাগুর মাছই আমাদের জন্যে ভালো ছিল। এছাড়াও আমাদের দেশে কতরকম ফল হয়—আম জাম কাঁঠাল কলা পেয়ারা আতা আনারস মেওয়া সফেদা পানিফল কঁচুফল আরও কত কী। ডালিম এ মাটিতে হয় বলেই না কবি লিখেছেন, এইখানে তোর দাদির কবর, ডালিম—গাছের তলে…।

সে সব গাছ এখন গেল কোথায়? এত ফল থাকতে ওষুধ মেশানো আপেল কমলা আঙুর কেন আমদানি করতে হবে, আমি তা বুঝি না। যদি মনে করা হয় যে, জনসংখ্যা বাড়ছে, কীভাবে খাদ্যের সংস্থান হবে? তাহলে এখানে এই মাটিতে যা সহজে ফলে, তাই বেশি করে উৎপাদন করি না কেন আমরা? কেননা আমার সুস্থতার জন্যে আমার চারপাশে যখন যা পাওয়া যায়, সেটাই সবচেয়ে উপকারী। পৃথিবীর যে অংশে আমরা বাস করছি, সেখানকার মধুটাই আমার জন্যে উপযুক্ত। অস্ট্রেলিয়ান মধু খাওয়ার আমার দরকার নেই। কারণ অস্ট্রেলিয়ান ফুল আলাদা, ওখানাকার ব্যাধিও আলাদা। বুঝি না বলেই এ জাতীয় ভুলগুলো আমরা করি। প্রকৃতি একেকটা জায়াগার প্রয়োজন বুঝে সেখানে সেই জিনিসগুলো সেভাবে দিয়েছে। আর এটা অনুসরণের মধ্যেই কল্যাণ। যে কারণে কাবা শরিফে আমাদের ঘূর্ণনের দিক আর দরবেশের ঘূর্ণনের দিক নির্ধারিত হচ্ছে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এটা একটা ন্যাচরাল অর্ডার।

সুফি দার্শনিক জালালুদ্দীন রুমির ‘An Egypt that does not exist’ কবিতায় প্রথমেই বলা হয়েছে, The prophet said, there are some who see me by the same light in which I’m seeing them. অর্থাৎ যে আলোতে আমি অন্যকে দেখি, সেই আলোতে অন্যেরা আমাকে দেখতে পারে।

রুমি বলেছেন, আত্মা যদি শুদ্ধ হয়, হৃদয় যদি ঝকঝকে আর পরিষ্কার হয়, একটি স্বচ্ছ কাচের আয়নার মতো হয়, তাহলে সেখানে ঐশী বার্তা আসবে। আমরা বলতে পারি, আমাদের নতুন নতুন মেসেজ পাওয়ার জন্য চাই একটি বিশুদ্ধ অন্তর। এ মেসেজ আসতে পারে যেকোনো জায়গা থেকে— (from here, from the stars, from the void) তারা থেকে, সূর্য থেকে, এমনকি শূন্য থেকেও। পরবর্তীতে তরিকায়ে আহমাদীয়ায় লতিফায়ে খলা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে (void) শূন্য বা খলার স্বরুপ উন্মোচন করেছে। বিজ্ঞানের আলোকে এর তাৎপর্য একটি স্বতন্ত্র নিবন্ধে আলোচিত হবে।

হজরত গাউসুল আজম শায়খ সায়্যিদ মুহিউদ্দীন আবদুল কাদির জিলানী (রহ:) —কে আমরা আউলিয়াকুল শিরোমণি মান্য করি। তাঁর একটি গ্রন্থ যেদিন প্রথম পড়লাম তখন আমার কাছে মনে হলো, এরচেয়ে বড় সায়েন্টেফিক প্রিন্সিপাল আর কী হতে পারে! তিনি সেখানে বলেছেন,[জিলানী (রহ:), আবদুল কাদির, ফতহুল গায়েব] আমরা একজন বিচারককে চিনি কীভাবে? তাঁর বিচার প্রক্রিয়া দেখে। যেমন, আমরা কেউই হজরত সোলায়মান (আ.)—কে দেখিনি। কিন্তু তাঁর বিচার সম্পর্কে শুনেছি। তিনি বিচারক হিসেবে কত বিজ্ঞ ছিলেন, তা আমরা বুঝতে পারি একটি ঘটনা থেকে।

ঘটনাটি হচ্ছে, দুই মা কাড়াকাড়ি করছে একটা ছেলেকে নিয়ে। এক মা বলছে, এটা আমার ছেলে; আরেক মা বলছে, আমার ছেলে। ছেলের দাবি নিয়ে দুজনের বিবাদ দেখে তিনি বললেন, ঠিক আছে, তোমরা দুজনেই যেহেতু মা বলে দাবি করছ—তাহলে এই ছেলেকে সমান দুইভাগে ভাগ করে তোমাদের দিয়ে দিচ্ছি। এটা শুনে সত্যিকার মা যিনি, তিনি বললেন, থাক দরকার নেই। আমি ওর মাতৃত্ব দাবি করছি না। ওই মহিলার কাছেই ছেলেকে দিয়ে দিন। তখন হজরত সোলায়মান বুঝে গেলেন কে আসল মা। কত বিজ্ঞ ছিলেন তিনি!

একইভাবে আমরা একজন শিল্পীকে চিনি কীভাবে? তাঁর শিল্পকর্ম দেখে। তিনি কোন রং কীভাবে ব্যবহার করেছেন, কতভাবে কারুকাজ করেছেন, সেটা দেখে আমরা বলি যে, তিনি কোন পর্যায়ের শিল্পী। যখন ইট—বালু—সিমেন্ট দিয়ে, তার সাথে সিরামিকসের কারুকাজ করে কোনো স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়, সেটা দেখে আমরা বুঝতে পারি— কারিগর বা আর্কিটে্ক্ট কোন স্তরের। যেমন, তাজমহল। সিমেট্রি স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে নিঃসন্দেহে এটি একটি চমৎকার স্থাপনা। যে তুর্কি স্থাপত্যবিদ এর ডিজাইন করেছেন, তাঁর সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা করতে পারি তাজমহল দেখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামের নবুয়্যাতের মর্ম বুঝাতে যেয়ে ইমাম রাব্বানী মুজাদ্দেদে আলফে সানী শায়খ আহমাদ ফারুকী সেরহেন্দী (রহ:) একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।

মুজাদ্দেদে আলফে সানী বলেছেন, ‘‘তোমরা তো জালিয়ানুস্ ও সীবুয়াকে দেখনি। বল দেখি, তোমরা কীভাবে জানলে যে, তিনি একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক ছিলেন এবং ‘‘সীবুয়া’’ ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ? যদি তুমি জবাবে বল যে, আমি চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যায়ন করেছি এবং তাঁর লেখা গ্রন্থরাজি পাঠ করেছি; ফলে জানতে পেরেছি যে, তিনি রোগ এবং রোগ দূর করার চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। আর এভাবেই আমি জানতে পেরেছি যে, তিনি একজন বিজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। এভাবেই আমি ব্যাকরণের জ্ঞান হাসিল করেছি সীবুয়ার গ্রন্থরাজি থেকে, তাই নিশ্চিত জেনেছি যে, তিনি ছিলেন একজন ব্যাকরণবিদ।

এরূপেই আমি বলতে চাই যে, যখন তুমি নবুয়্যাতের অর্থ জানতে চাইবে তখন কুরআন ও হাদীসের প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করবে; তখন তুমি অবশ্যই জানতে পারবে যে, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়্যাতের সর্বোত্তম মর্যাদায় বিভূষিত এবং সময়ের দূরত্বের কারণে এ সত্য প্রত্যায়নে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি। কেনান, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমস্ত কথাবার্তা, ক্রিয়া—কর্ম, নেক—আমল ইত্যাদি মানবতার পূর্ণতার সংবাদ প্রদান করে এবং রোগগ্রস্ত দিলের (অন্তরের) চিকিৎসা এবং তার মলিনতা বিদূরণের প্রক্রিয়ার খবর দেয়। বস্তুত নবুয়্যাতের অর্থ এছাড়া আর কিছুই নয়।” [আলফে সানী (রহ:), মুজাদ্দেদ, ইসবাতুন নবুয়্যাত]

আমরা দেখতে পাই, হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রা.)’র বক্তব্যেও এর সাদৃশ্যতা। তিনি বলেছেন যে, আমরা যেরকম বিচার দেখে বিচারককে চিনি, কারুকার্য দেখে কারিগরকে চিনি, ঠিক একইভাবে সৃষ্টির যা—কিছু আছে, তা দেখে স্রষ্টাকে চিনতে হবে। তাই একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির উচিত প্রথমে নিজের দিকে তাকানো, নিজের দিকে মানে নিজের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকে তাকানো। সেগুলোর বিন্যাসকে বোঝার চেষ্টা করা। তারপর তাকে তাকাতে হবে অন্যান্য সৃষ্টির দিকে। তাহলেই সে স্রষ্টার দলিলকে বুঝতে পারবে। স্রষ্টাকে বুঝতে পারবে। যেরকম একজন স্থপতির দলিল হচ্ছে তাঁর নির্মিত স্থাপত্যকর্ম, একজন বিচারকের দলিল হচ্ছে তাঁর রায় এবং যে প্রক্রিয়ায় সে রায়টি নির্ধাতির হয়, তেমনি স্রষ্টার দলিল হচ্ছে তাঁর সকল সৃষ্টি। এই সৃষ্টিকে বুঝতে পারলেই, সৃষ্টিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারলেই স্রষ্টাকে বোঝা যাবে। যে কারণে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘‘আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে যা—কিছু আছে, তার প্রতিটি জিনিসের দিকে তাকাও।” [আল কুরআন, সূরা ইউনূস (১০: ১০১)]

বার বার নজর দিতে বলা হয়েছে। বিজ্ঞানও একই সুরে বলে, মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি রয়েছে, তার দিকেও দৃষ্টিপাত করতে হবে। বিজ্ঞানীদের কাজের এজেন্ডা তো এটাই। তাই বলা হয়, বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের কোন বিরোধ নেই। এই বিষয়টির উপর আমার একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রয়েছে। [আলী, এম শমশের, সায়েন্টিফিক ইন্ডিকেশন ইন দ্য হোলি কুর’আন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ৪র্থ সংস্করণ, জুন ২০১৪]

আমরা বলি যে, ‘আয়াত’ এর মানে হলো নিদর্শন। কুরআনের সব আয়াতের যদি একটি সারমর্ম করেন, তবে দেখবেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আয়াতগুলো বিজ্ঞানসংক্রান্ত। এখানে যে নিদর্শনগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো কিন্তু বিজ্ঞান। এখন বিজ্ঞানের জগতের পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাটির সম্পর্কে জানার প্রয়াস চলছে। আর যে জিনিসি যত ছোট তাকে জানার জন্যে আয়োজনটা তত বড়। একটি হাতিকে দেখতে হলে আমাকে কিছুই করতে হয় না, সাধারণ আলোয় আমি দেখতে পারি; কিন্তু একটা ইলেকট্রনকে দেখতে হলে গামা—রে দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে হয়।

আসলে হজরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যে দলিলটি পড়তে বলেছেন, আমরা সাধারণ মানুষেরা সেটা পড়তে পারি না কেন? কারণ এই দলিলের ভাষাটা হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান দিয়ে এই দলিলকে পড়তে হবে। অনেক তরুণ আছে, বিজ্ঞান সম্পর্কে এক—আধটু জেনেই প্রশ্ন করে বসে, বিজ্ঞান দিয়ে তো সব কিছু ব্যাখ্যা করা যায়; কিন্তু স্রষ্টা কে, তিনি কোথায় থাকেন, তাঁকে তো দেখি না। অথচ বড়পীরের কথার মধ্যেই তাদের এ প্রশ্নের উত্তর আছে যে, সৃষ্টির মধ্য দিয়েই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। এই যে পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে এক মহাবিস্ফোরণ হলো, বিজ্ঞানীরা যাকে বলেছেন বিগ ব্যাং, এর ইঙ্গিত কুরআনে আছে। আল্লাহ্ বলেছেন,

“আকাশ এবং পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে একসঙ্গে ছিল, আমি একটা বিরাট বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে তা আলাদা করে দিলাম। পানি থেকে সবাইকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তোমরা বিশ্বাস করবে না?”[আল কুরআন,সূরা আম্বিয়া (২১:৩০)]

আল্লাহ্ তায়ালা কিন্তু জোর করছেন না। স্বচক্ষে প্রমাণ দেখে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলছেন। দোজখের শাস্তি বা বেহেশতের সুখ দেখিয়েও বিশ্বাস স্থাপন করতে বলছেন না। কারণ এগুলো তো সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্যে উপমা মাত্র। বরং তিনি যে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, জীবন সৃষ্টি করলেন সেদিকে তাকাতে বলেছেন। কারণ এর মধ্যেই বিশ্বাসীদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। তাই আল্লাহ বলেন— “নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের জন্যে রয়েছে নিদর্শন।” [আল কুরআন, সূরা আর রুম (৩০:২১)]

পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বের সর্বত্র দেখুন। সেখানে প্রায় সবটুকু পদার্থই রয়েছে প্লাজমা ফর্মে। প্রচন্ড তাপে, প্রচন্ড চাপে পদার্থের ইলেকট্রন আর প্রোটন আলাদা হয়ে গিয়ে সেখানে পদার্থ এখনকার মতো নেই। সেখানে এটম নেই, মলিকিউল নেই। আর পৃথিবীর মধ্যে দেখুন। এখানে স্রষ্টা পদার্থ সৃষ্টি করেছেন কখনো বায়বীয়, কখনো তরল, কখনো কঠিনরূপে। পিরিয়ডিক টেবিলে শুরুতে আছে হাইড্রোজেন। আর সব শেষে আছে ইউরেনিয়াম। দুটোই প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ওজনের দিকে থেকে হাইড্রোজেন সবচেয়ে হালকা আর ইউরেনিয়াম সবচেয়ে ভারী। এটাকে অকাজে ব্যবহার করলে ধ্বংসযজ্ঞ হবে আর ভালো কাজে ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, যেমনটা ফ্রান্সসহ অনেক দেশই করছে।

আবার একটা নিউক্লিয়াসের মধ্যে তিনটি প্রোটন আর তিনটি নিউট্রন থাকলে সেটা হয় লিথিয়াম। যদি একটা বাড়িয়ে দেয়া হয়— তিনটার জায়গায় চারটা করে দেয়া হয়, তাহলে সেটা বেরিলিয়াম হয়ে যাবে। তখন এটা আবার অন্যরকম হবে —আনস্টেবল। আবার যদি ছয়টা করে দেয়া হয়, হবে কার্বন। অর্থাৎ একটা নিউট্রন, একটা প্রোটন —এই বিন্যাসটা বদলে দিলে কখনো একটা গ্যাস, কখনো লিকুইড, কখনো বা সলিড, কখনো এটা এই রঙের, কখনো ওই রঙের হয়ে যাচ্ছে। সামান্য একটু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পদার্থের অবস্থা কী রকম বদলে যাচ্ছে—ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে।

কত বড় সুফি ছিলেন বড়পির। তিনি বলছেন যে, সৃষ্টি করা জিনিসগুলো দেখ, দলিলটা দেখ, দলিল দেখে স্রষ্টাকে দেখ। দলিল দেখে স্রষ্টাকে বোঝার চেষ্টা করো। পদার্থকে ভালো করে বোঝো। নিজের ভেতরটাকে বোঝো। তিনি যখন নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকে নজর দিতে বলেছেন, ডিএনএ মলিকিউল সম্পর্কে কোন ধারণা কি তখন মানুষের ছিল? এই তো সেদিন, বিংশ শতাব্দীর ৫০—এর দশকে কেমব্রিজ ডিএনএ মলিকিউলের গঠন আবিষ্কৃত হলো যে, ডিএনএ আমাদের অর্থাৎ মানুষের প্রাণের নীলনকশা হিসেবে কাজ করছে। ধরুন, আমরা যে খাবার খাই, সেটা প্রোটিন হলে পাকস্থলিতে ঢোকার পর বিভিন্ন এমাইনো এসিডে এটা ভাঙছে। আবার এক ধরনের ট্রান্সফার আরএনএ আছে, যা এই এমাইনো এসিডগুলোকে নিয়ে গিয়ে একটা বিশেষ জিওমেট্রিক্যাল পজিশনে সংযুক্ত করছে। এখানে আপনার—আমার সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই। আমরা এর জন্যে কোনো অর্ডার বা নির্দেশও দেইনি।

সব হচ্ছে সয়ংক্রিয়ভাবে, একটি ফ্লোচার্ট অনুসরণ করে, একের পর এক। যেমনটা দেখা যায় পেপার মিলে—মেশিনের একপাশে আখের ছোবড়া, পুরনো কাগজ, পাতলা কাঠ—সবকিছু ঢোকানো হচ্ছে আর মেশিনের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে ঝকঝকে সাদা কাগজ। পুরো ঘটনাটা কিন্তু এমনি এমনি হয় না। কীভাবে প্রসেসিং করতে হবে, তার একটা ফ্লো—চার্ট আছে। প্রথমে এটা দাও, তারপরে পানি দাও, তারপরে এটা করো, ওটা করো, তাহলেই ওপাশে বের হয়ে আসবে সুন্দর সাদা কাগজ। এবং ইঞ্জিনিয়াররা এই ফ্লো—চার্ট আগেই তৈরি করে দিয়েছেন বলেই ওদিকে কাগজ বের হতে পারছে। একবার চিন্তা করুন, একটি কাগজের জন্যে যদি এরকম ফ্লো-চার্ট থাকে, তাহলে মানুষেরও তো তা আছে। তাহলে এই ফ্লোচার্ট কে তৈরি করল?

হজরত বড়পির এজন্যেই নিজের দিকে তাকাতে বলেছেন। তাহলেই মানুষ বুঝতে পারবে, এই যে কয়েকশ কোটি মানুষ আছে পৃথিবীতে, কেউ কারো মতো নয়। কারো জিনের সাথে কারো জিনের হুবহু মিল নেই। ডিএনএ—র গঠনেও কোন মিল নেই। এই যে সৃষ্টিবৈচিত্র্য, এটা বোঝার জন্যে মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে যে নিদর্শন আছে সেটা যেমন দেখতে হবে, তেমনি শরীর নামক যে মহাবিশ্ব আছে, সেটাও বুঝতে হবে। তবে শরীরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ, এটা বোঝার জন্য বেশ আয়োজন করতে হয়।

যেমন, আগেই বলেছি, একটা হাতি দেখতে আমাদের কোন অসুবিধা হয় না। দিনের আলোয় যেমন দেখতে পারি, তেমনি রাতের আঁধারেও হাতির অস্তিত্ব বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু একটা ইলেকট্রনকে গামা—রে দিয়ে দেখতে হয়। আর গামা—রে তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। শরীরের ভেতরে কী হচ্ছে, তা বোঝার জন্যে এক্স—রে ছাড়া হয় না। কেন? যাকে দেখছি তা, যা দিয়ে দেখছি তার চেয়ে বড় হতে হবে। ঘুরিয়ে যদি বলি—যা দিয়ে দেখছি তা, যাকে দেখছি তার চেয়ে ছোট হতে হবে। এজন্যেই সুইজারল্যান্ডের সার্ন ল্যাবরেটরিতে লার্জ হ্যাডরন কোলাইডার দিয়ে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাটাকেও জানার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ বিগ ব্যাং—এর মধ্য দিয়ে পৃথিবী এবং বাদবাকি যা—কিছু সৃষ্টি, এর সবই যেহেতু স্রষ্টার দলিল, এগুলো বোঝার মধ্য দিয়েই আমরা স্রষ্টাকে বুঝতে পারব। সুফিদের এই চেতনার উৎস কোথায়? উত্তর হবে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই তাঁর সোহবত প্রাপ্ত সাহাবিদের মাঝেও এর পূর্ণ পরিলক্ষিত হয়।

হজরত আলী ইবনে আবু তালিব রাদ্বিআল্লাহু তাআলা আনহু সম্পর্কে আমাদের প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমি যদি জ্ঞানের নগরী হই, তাহলে এর দরজা হচ্ছে আলী।১০ তিনি হচ্ছে দরজা, তুর্কি ভাষায় যাকে বলে ‘বাব’। হজরত আলী রাদ্বিআল্লাহু তাআলা আনহু—কে কেন নবিজি এই অভিধায় অভিহিত করলেন, সে সম্পর্কে আমরা আসব একটু পরে। হজরত আলী রাদ্বিআল্লাহু তাআলা আনহু গভীর পান্ডিত্যের অধকারী ছিলেন। সেই সময় তিনি ‘‘দারুল হিকমা” প্রতিষ্ঠা করেন।

যারা সত্যিকার অর্থে কাশফের জগতে বিচরণ করতে পারেন, তাঁরা দেখেন অনেক কিছু। তাঁরা জানেন অনেক কিছু। কাশফের জগৎ এত উন্নত।

লতিফা বা স্টেশন (আল্লাহর জিকিরের সূক্ষস্থল); বিশিষ্ট সুফি ইমামত তরিকত আল্লামা শায়খ সায়্যিদ বোরহানুদ্দীন উয়েসীর (রহ.) ‘তরিকায়ে আহমদিয়া’ বক্তব্য অনুযায়ী মানবদেহের অভ্যন্তরীণ ফাঁকাস্থান নম্রতার ভিত্তি । ‘খলা’ এর আক্ষরিক অর্থ খালি/শূন্য বা শূন্যতা। যা বিজ্ঞানের ‘‘Matter is mostly empty” এই ধারনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পদার্থবিজ্ঞানের যে কোনো শিক্ষার্থী শনাক্ত করতে পারে যে শূন্য একটি বিশেষ আকর্ষনীয় বিষয়, বিশেষ করে পরমাণু বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছে তাই ‘লতিফায়ে খলা’ একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা। আমি লতিফায়ে খলার বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য নিয়ে একটি পৃথক নিবন্ধ লিখেছি।

পরিশেষে বলা যায়, সুফিরা ইলহাম, কাশফ বা ইলমে লাদুন্নির মাধ্যমে এমন সব তথ্য আহরন করতে পারেন যা বিজ্ঞানের আলোকে গুরুত্ব বহন করে।

কৃত: প্রফেসর ড. এম শমশের আলী
পরমাণু বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ
প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a comment