জন্ম, জীবন, মৃত্যু এই তিনেই বাঁধা আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের চিন্তা—চেতনা। জন্মের উপর আপনার হাত নেই, মৃত্যুটাও অনিশ্চিত। জন্মের পর ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে বরাদ্দকৃত জীবন। ওয়ান ওয়ে টিকেটে চলছি অনিশ্চিত ব্যপ্তির নিশ্চিত গন্তব্যের দিকে, সেটা নিশ্চিত মৃত্যু।
যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।
(সুরা মূলক: ০২)
আজ এই ক্ষণ, এই মুহুর্ত থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি সময়টার মধ্যেই আমার ভালো থাকা, মন্দ থাকা, সুস্থ থাকা, অসুস্থ থাকা, চিন্তা—চেতনা, মানুষ হওয়া বা অমানুষ হওয়ার মহড়া। ততদিনে শরীরে বাসা বাঁধে প্রেশার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাড় কুড়মুড়ে রোগ।
মানুষের সুস্থতা তার নিজের হাতে, কেননা সব রোগের ওষুধ আছে প্রকৃতিতে! খাদ্যই পথ্য; মানুষের দায়িত্ব শুধু প্রকৃতির ইশারা বুঝে খাবার খাওয়া। আজকাল মানুষ বেশি মাত্রায় অসুস্থ হচ্ছে স্রেফ তার নিজের দোষে উল্টাপাল্টা খাবার খেয়ে। আমাদের অধিকাংশের জীবনদৃষ্টি সঠিক নয়, না জানার কারণে প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে অনেক ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে—যে কারণে সবাইকে কম—বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আমরা এখন অল্পতেই অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছি এবং বুঝে না বুঝে নানা রকম ওষুধ গিলছি—যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারেও কেউ ন্যূনতম সচেতন নন। ভুল চিকিৎসার কারণে প্রতি বছর চার হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে আর অকালে মারা যাচ্ছেন অগণিত মানুষ।
বাংলাদেশে এখন প্রতি ১১ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, ৫৩% মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইরত ১০ লাখ ক্যান্সার রোগীর সঙ্গে প্রতিবছর নতুন করে যোগ হচ্ছে আরো দুই লাখ মানুষ। প্রতিবছর ৬০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হচ্ছে। ১৭% বাংলাদেশি স্থুলতায় আক্রান্ত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্থূলতা একটি রোগ এবং এ থেকেই সকল রোগের সূত্রপাত। জীবনের সব সঞ্চয় হাসপাতাল,ওষুধ আর ডাক্তারের হাতে তুলে দেওয়ার পরও রোগ আর দুর্ভোগের হাত থেকে চূড়ান্ত নিষ্কৃতি মিলছে না— এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই। আমরা ভুল খাবার ভুলভাবে, ভুল পরিমাণে ও ভুল সময়ে খেয়ে শরীরের ‘বারোটা’ বাজাচ্ছি। এ থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা কোনো হাসপাতাল, ডাক্তার কিংবা ওষুধের নেই—যদি আমরা খাদ্য গ্রহণে সতর্ক ও সচেতন না হই।
ধর্মীয় বিধিবিধান না মেনে প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে প্রকৃতি ঠিকই তার প্রতিশোধ নিবে। মানুষ মূলত তিন ধরনের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে গুরুত্ব অনুসারে এগুলো যথাক্রমে বায়ু (অক্সিজেন), তরল (পানি ও অন্যান্য) এবং কঠিন (শক্ত খাবার)। স্রেফ অজ্ঞতার কারণে আমরা ন্যূনতম (মাত্র ৩০%) বাতাস নিয়ে বেঁচে থাকি। কিন্তু সঠিক নিয়মে পর্যাপ্ত বাতাস গ্রহণ ও সঠিক নিয়মে পানি পান করলে জীবনভর সুস্থ থাকা সম্ভব।
সুবিশাল প্রকৃতির কাছে আমরা নিতান্তই নগণ্য। চিন্তাশক্তির স্বধীনতা নিয়ে, চলার, বলার স্বাধীনতা নিয়ে কখনো—কখনো আমরা লঙ্ঘন করে ফেলি আমাদের সীমানা। কখনো প্রকৃতি রাশ টানে। কখনো ব্যালেন্স করে, কখনো ধাক্কা দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়। খেতে খেতে ভুঁড়ি বানানো লোকটাও একসময় থামে, থামতে বাধ্য হয়। ডায়াবেটিসের ডাক্তার বলেন চিনি, গুড়, মিষ্টি খাবেন না। ভাতটাও মেপে খেতে হয়! হার্টের ডাক্তার নিষেধাজ্ঞা জারি করেন গরু, খাসী, ডিম, চর্বির উপর।
প্রচন্ড প্রতাপশালী মানুষটাও একসময় অসহায় আত্মসমর্পণ করেন বার্ধক্যের অক্ষমতার কাছে। ক্ষমতা, বিত্ত—বৈভব আর প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ অহংকারে স্ফীতবুক মানুষটাও একসময় আত্মসমর্পণ করেন সামান্য চিনির কাছে। চিনিটা হজম করতে পারেন না। তিনি নিজের গায়ে নিজে সুঁই ফুটান অবলীলায়। তিনবেলা ইনসুলিন নেন নিজের হাতেই। সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোঁয়ার বলয় উড়ানো মানুষটাই একসময় বাতাসটা টেনে নিতে পারেন না ভিতরে। বাতাসটা কিনে নিতে হয় প্রতিটা ভেনটোলিন টেবলেট ও ইনহেলারের দুইটি চাপের বিনিময়ে।
প্রকৃতির এই ভারসাম্যের খেয়ালের জন্যই বোধ হয় আমরা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নিজেদের। দেখে দেখে উপলব্ধি করতে শিখি নিজেদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতকে। আহা! আত্মোপলব্ধিটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।
আল্লাহর এই যে, এতো সুন্দর সুন্দর সব সৃষ্টি, এগুলোর অবজার্ভার কোথায়? দর্শক ছাড়া এটা সম্পূর্ণ নয়। এই যে নদী ও ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হচ্ছে সুন্দরভাবে, সমুদ্রের গর্জন, পাখি গান গাইছে সবমিলিয়ে পৃথিবীর মধুর সব ধ্বনী আর দৃশ্য চারপাশের এত ঘটনা কেউ যদি না দেখে, না শোনে, তবে কেমন করে হবে? একজন দর্শক এখানে দরকার। একজন শ্রোতা দরকার। বিজ্ঞানের জগতে যাকে বলে অবজার্ভার। এজন্যই আল্লাহ বারবার তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকাতে বলছেন মানুষকে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষের চাইতে বড় বিস্ময় আর অপূর্ব সৃষ্টি অন্যকিছু নেই। আর এই বিষয়টা বুঝলেই মানুষ কখনো দুর্গতির মধ্যে থাকতে পারে না। সেই মানুষ মূর্খ থাকতে পারে না। হতাশাচ্ছন্ন থাকতে পারে না। এটা অনুধাবন করা সবারই দায়িত্ব। এই মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্যেই তো আল কোরআন। এটা বর্তমান বিশ্বের কোনো নির্দিষ্ট জাতি গোত্রের জন্য নয় বরং পুরো মানবজাতির জন্য পথ নির্দেশিকা। এই বিষয়গুলো গভীর ভাবে উপলব্ধি হওয়ার জন্য প্রয়োজন তাফাককুর বা মুরাকাবা।
যুগে যুগে দেশে দেশে সাধকরা আত্মোপলব্ধির জন্য এ প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছেন। স্রষ্টায় সমর্পণের জন্য সুফিসাধকরা নিমগ্ন হয়েছেন মুরাকাবা মুশাহেদায়। তাফাক্ক্কুর বা তাদাব্বুরের যে কথা কোরআনে বলা হয়েছে তা আসলে সৃষ্টি রহস্য নিয়ে ধ্যানেরই তাগিদ।
মুরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে মানুষ আত্মনিমগ্ন হয়ে তার এ বিশাল সম্ভবনাকে জানতে পারে। সে তার স্রষ্টাকে চিনতে পারে যথাযথভাবে। তার নামাজে প্রতিটি সেজদা পরিণত হয় মেরাজে। সে ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া পথে অগ্রসর হয় । হুদরিল কলব বা একাগ্রচিত্ত ছাড়া নামাজ কবুল হয় না। শুধু রুকু সেজদা দিলে, সুরা কেরাত পড়লে নামাজ হয় না। নামাজের জন্য প্রয়োজন হুদরিল কলব। তাই যারা ইবাদত বন্দেগিতে একাগ্রচিত্ত হতে চান। মুরাকাবা তাদের চমৎকারভাবে সাহায্য করবে। নামাজ ঠিকভাবে পড়ার জন্য মনোযোগ প্রয়োজন। আর মুরাকাবা মানুষের মনকে বর্তমানে নিয়ে আসে।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক ঘন্টার ধ্যান সারা বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। এছাড়া হজরত আবু হুরায়রা রাদ্বিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘন্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। [মেশকাত]
তবে ধ্যানকে কার্যকরী ও ফলপ্রসূ করার জন্যে আল্লাহ কিছু খুঁটি ঠিক করে দিয়েছেন,যা তে আমরা দিকভ্রান্ত না হই বা ছিটকে না পড়ি। কালেমা, নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ ইসলামের এই ফরজ গুলোই সেই খুঁটি। আল্লাহ মানুষের মনে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা যথাযথভাবে কাজে লাগানোর হাতিয়ার হচ্ছে মেডিটেশন। মুরাকাবা বা ধ্যান মানুষকে তার মনের ওপর এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। ইসলামে ধ্যান বা মেডিটেশনকে একটি উচ্চ স্তরের ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। পবিত্র গ্রন্থ কোরআনে বহু জায়গায় সরাসরি মেডিটেশনের কথা বলা হয়েছে। কোরআনে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে তাফাক্কুর। এর অর্থ হচ্ছে কনটেমপ্লেশন, মেডিটেশন বা ধ্যান। সুরা আলে ইমরানের ১৯০—১৯১ আয়াতে আল্লাহ জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে গভীর ধ্যানে (তাফাক্কুর) নিমগ্ন হয়’।
আল কোরআনের সুরা আনআমে আল্লাহ বলেন, হে নবি! ওদের জিজ্ঞেস করো, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি কখনো সমান হতে পারে? তোমরা কি এরপরও কোরআনের শিক্ষা অনুধাবনে) গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হবে না (বা তোমাদের সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না)? [৬:৫০]
সুরা সুয়াদে আল্লাহ বলেন, হে নবি! আমি তোমার ওপর এই কল্যাণময় কিতাব নাজিল করেছি, যাতে মানুষ এই কোরআনের বাণী নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়! (সেই সঙ্গে সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে) এর শিক্ষা অনুসরণ করে। [৩৮:২৯]
একইভাবে সুরা মুহাম্মদের ৪৭: (২২,২৩,২৪) আয়াতে আল্লাহ বলেন, (হে নবি! ওদের জিজ্ঞেস করো) তোমরা যদি (আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে পুরনো ধ্যান ধারণায়) ফিরে যাও, তবে কি তোমরা দুনিয়ার বুকে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে? বন্ধন ছিন্ন করে পরস্পর বিবাদ—বিসংবাদে লিপ্ত হবে? এদেরকেই আল্লাহ তার রহমত থেকে বঞ্চিত করেন, (সত্যের ব্যাপারে) বধির ও অন্ধ করেন। এরপরও কি ওরা কোরআন নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে তা অন্তরে ধারণ করবে না? নাকি মনের দরজা বন্ধই করে রাখবে?
সুরা—আলে ইমরানের ১৯০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, যারা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে এই দিবা রাত্রির আবর্তন এবং আমার সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাকরে তারা বলে উঠবে—হে আল্লাহ বিনা করণে তুমি এসব সৃষ্টি করোনি।
এই আয়াতটি গভীরভাবে খেয়াল করলেই আমরা দেখি যে ইকো—সিস্টেম। যাকে আমরা পরিবেশ বিজ্ঞান বলি। পুরো পরিবেশ বিজ্ঞান এই কথাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে যে, হে প্রভু! বিনা কারণে তুমি এসব সৃষ্টি করোনি। একটা পিঁপড়া একটা হরিণ, একটা হাতি, উট কিংবা একটা গোলাপ ফুল কোনো কিছুই কারণ ছাড়া সৃষ্টি করা হয়নি। এসবের জন্য প্রয়োজন গবেষণা। কারণ মানুষ মনোদৈহিক সিস্টেমসমৃদ্ধ এক অপূর্ব সৃষ্টি।
আজকের পৃথিবীতে কোনটা সবচেয়ে উচ্চতর প্রযুক্তি—ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ইনফরমেশন টেকনোলজির বিভিন্ন উদ্ভাবন নাকি অন্যকিছু? একেকজন একেকটি্র কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মানুষই এসব কিছু আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে, সেটা হচ্ছে মানব মস্তিষ্ক। এটাই হচ্ছে জ্ঞানজগতের লেটেস্ট ফ্রন্টিয়ার। তাই আমরা প্রকৃত শিক্ষার পাশাপাশি যতটা চিন্তা করতে পারবো, ধ্যান করতে শিখবো এ বিষয়গুলো আমারা বুঝতে সক্ষম হবো। ততই মানব জীবন সমৃদ্ধ হবে, প্রকৃতি নির্মল থাকবে, আমারা লাভ করবো স্রষ্টার সন্তুষ্টি। মুরাকাবা হলো অন্তরের ধ্বনি বা নীরব শব্দ শুনতে পাওয়া, কিংবা সে ধ্বনি শোনার চেষ্টা করা। যখন আমরা মুরাকাবা করি তখন আমরা নিজেকে উৎসশক্তির সাথে সংযুক্ত করি, যা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আমাদের মন, শরীর ও আত্মাকে রিচার্জ করে। সমস্ত আত্মা—জুড়ে নেমে আসে এক প্রকার প্রশান্তি।
মুরাকাবা/মেডিটেশন যার অর্থ হল গভীর চিন্তা বা ধ্যান। মেডিটেশন হলো মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে দেহ ও মনকে রিল্যাক্স করার সূক্ষ্ম কৌশল। এটি এমন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমাদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হ্রাস পায়। মেডিসিন এবং মেডিটেশন দুটোই ব্যবহৃত হয় নিরাময়ের কাজে। মেডিসিন মূলত নিরাময় করে দৈহিক রোগব্যধি। আর মেডিটেশন নিরাময় করে দেহ—মনের সকল সমস্যা। মেডিটেশনের পথ ধরেই ব্যক্তি চেতনা যুক্ত হয় মহাচেতনার সাথে।
ধ্যান এ আবার কি? এটা কি কোন চর্চার বিষয় হল! শুধু শুধু চোখ বুঝে সময় নষ্ট তার চেয়ে বরং এদিক ওদিক উকিঝুকি মারাই শ্রেয়! যারা এত দিন ধ্যানের কথা শুনেই অবজ্ঞা ভরে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলতেন তাদের জন্য খারাপ সংবাদ দিচ্ছেন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান।
নব নব আবিষ্কার ও নতুনত্বের সন্ধানে মত্ত থাকা পশ্চিমাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বিশেষ করে মনোজাগতিক চিকিৎসা শাস্ত্রকে আরো সহজ, সুলভ, গ্রহণযোগ্য উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সেই পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আগ্রহ এখন প্রাচীন ভারতের সাধু, সন্ন্যাসি, মুনি, ঋষি চর্চিত আচার ধ্যান সাধনায়। যাকে বৌদ্ধদের পরিভাষায় ভাবনা, তপস্যা ও তাফাক্কুরে উদ্দেশ্য ও আচরিত পদ্ধতিতে স্থূল পার্থক্য দেখা যায়। তারপরেও ইংরেজীতে সবগুলোকে এক কথায় বলা হয় মেডিটেশন (Meditation)।
মানুষের দেহ মন জুড়ে এই প্রাচীন ধ্যানবিদ্যার কার্যত কোন প্রশান্তির ছায়া পড়ে কি? নাকি তা শুধু কেবল দার্শনিক তত্ত্বের আজো সীমাবদ্ধ? এই সব জটিল তত্ত্বের নির্মোহ সত্যতা যাচায়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কাজে লাগিয়ে ধ্যান নিয়ে শুরু হয়েছে নানা কৌশলগত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রয়োগিক গবেষণা।
শরীরকে শিথিল করে মনের গভীরে প্রবেশ, অত:পর অবচেতন মনের অসীম শক্তিকে ব্যবহার করে নিরাময়, সুস্বাস্থ্য, সার্বিক সাফল্য অর্জনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত মাধ্যম হচ্ছে ধ্যান। ধ্যান ছাড়া প্রকৃত ও মৌলিক জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়,তাই ধ্যানই জ্ঞান। ধ্যানের মাধ্যমে দেহ শিথিল হলে ব্রেন তরঙ্গ আলফা লেভেলে চলে আসে; ব্রেনের ডান বলয় সজাগ হয়ে ওঠে। শ্বাসতন্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দের ফলে কমে আসে মানসিক চাপ, টেনশেন, উৎকন্ঠা, ভয়, রাগ, ক্ষোভ, রক্তচাপ। মনে জাগে একাগ্রতা আনন্দ ও প্রশান্তি।
আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী বলেছেন, মেডিটেশন বা ধ্যান হচ্ছে উচ্চস্তরের ইবাদত। বিশিষ্ট গবেষক ও মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মালিক বাদরি’র মেডিটেশন বিষয়ক গ্রন্থ “Contemplation: An Islamic Psycho-Spiritual study” এর ভূমিকায় ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, ‘গ্রন্থকার তার গ্রন্থে ধ্যান ও প্রশান্ত মনে সৎচিন্তার আলোকে বিচার করার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশাকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন’।
বছরের পর বছর হেরা গুহায় যে তিনি ধ্যানে কাটিয়েছেন, তা তো সবাই জানেন। তিনি যে মেডিটেশন করতেন তা বোঝা যায় বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. তারিক রামাদানের The Messenger : The meanings of the life of Muhammad বই থেকে। সেখানে তিনি বলেছেন, He did not demand of his companions the worship, fasting and meditation that he exacted of himself. অর্থাৎ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে ইবাদত করতেন, রোজা রাখতেন এবং মেডিটেশন করতেন, তিনি তার অনুসারীদের ওপর সে কঠোরতাকে চাপিয়ে দিতে চাননি। অনেক কিছু তিনি নিজে করেছেন কিন্তু অন্যদের জন্যে বলেছেন, তোমরা করলেও করতে পারো।
ইসলামের চিরায়িত ঐতিহ্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মুরাকাবা, তাফাক্কুর বা ধ্যান। যুগে যুগে নবি—রসুল, অলি—বুযুর্গ ও সাধকগণ এই ধ্যান—মুরাকাবা প্রক্রিয়ায় নিমগ্ন হয়ে আসছেন। হজরত ইব্রাহীম (আ:) এর মনে যখন প্রশ্ন জাগল কে আমার স্রষ্টা তখন তিনি ধ্যান—সাধনায় নিমগ্ন হলেন অবশেষে তিনি আল্লাহর পরিচয় লাভ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরা গুহায় ১৫ বছর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। ধ্যানের বহুমুখী গুরুত্বের তাগিদে মহাপুরুষ, অলি— আওলিয়াগণ ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছেন। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ ধ্যান—চর্চার উজ্জল দৃষ্টান্ত। হজরত মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহমাতুল্লাহি আলাইহি যিনি বিশেষ পদ্ধতির মুরাকাবার উদ্ভাবক। একদা তিনি গোলাপ বাগানে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। নব্যবিবাহিত এক দম্পতি বৃদ্ধ সাধককে বাগানে দেখে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে ‘‘এ বৃদ্ধ বাগানে চোখ বন্ধ করে কি করছে?”। মাওলানা রুমি বলেন, আমি চোখ বন্ধ করে যা দেখি, যদি তোমরা তা দেখতে আমি তো মাঝে মাঝে চোখ খুলি, তোমরা তাও খুলতে না।
ধ্যান নানা রকম হতে পারে। সব মিলিয়েই ধ্যান বিষয়টিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটি হলো প্যাসিভ অন্যটি হল—ডায়নামিক। প্যাসিভ মেডিটেশন হচ্ছে জগতের সকল মোহ—মায়া ত্যাগ করে তাঁরা কেবল সৃষ্টিকর্তাকে পাবার জন্য ধ্যান করেন। ডায়নামিক মেডিটেশন তাদের জন্য যারা ধ্যানের মাধ্যমে জাগতিক সাফল্য ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির উন্নয়ন ঘটাতে চান।
মেডিটেশন এর মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে একাগ্রতা, একাত্মতা প্রতিটি কাজকেই ধ্যান বা মেডিটেশনে পরিণত করে। আর কাজ ধ্যানে পরিণত হলেই আসে সাফল্য, সুখ, সু—স্বাস্থ্য, অর্থ, সম্পর্ক, ক্যারিয়ার এবং আধ্যাত্মিকতা।
মেডিটেশন আপনাকে শ্বাস—প্রশ্বাস প্রক্রিয়া সহজ করতে, শিথিল করতে, শক্তি বৃদ্ধিতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, উন্নত স্বাস্থ্য তৈরীতে, মানসিক প্রশান্তি অর্জনে সাহায্য করবে।
মেডিটেশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনার দেহ, মন ও আত্মাকে প্রশান্ত রাখা, কারণ একটি শিথিলায়িত মন ও দেহ উত্তেজিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থার চেয়ে অধিকতর সুদক্ষ সক্রিয়। যার ফলে সৃষ্টি হয় সুস্বাস্থ্য, ধৈর্য, সহমর্মিতা। এতে আপনার দৈনন্দিন রুটিন মাফিক কাজ করার ক্ষেত্রে অধিকতর সচেতন থাকবেন। সজাগ থাকবেন। প্রতিদিনের জীবন উন্নত হবে। একটি সুখী স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী হবে, সৃষ্টিশীল হবেন। মেডিটেশন মনের ব্যয়াম যা কি’না নীরবে বসে থেকে মনকে চিন্তামুক্ত করা বলে পরিচিত। মেডিটেশন খুবই সহজ যেমন হতে পারে তেমনি অবাক করা কঠিনও লাগতে পারে। মনের অন্তর্নিহিত কথা বুঝতে সাহায্য করে। ভালোবাসায় আমাদের মন—প্রাণকে পরিপূর্ণ করে তোলে। মন মেজাজ নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখতে ও নিজেকে ভালোবাসতে সহায়তা করে। এছাড়াও চেতনা বৃদ্ধির সাথে সাথে মেডিটেশন হচ্ছে কর্মব্যস্ত জীবন এক টুকরো বিরতির ন্যায়। যা আমাদের সামনে খুলে দেয় এক নতুন পৃথিবীর দুয়ার।
যখন আমরা মুরাকাবা করি তখন আমরা নিজেকে উৎসশক্তির সাথে সংযুক্ত করি, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমাদের মন, শরীর ও আত্মাকে রিচার্জ করে। ফলে একাগ্রচিত্ততা বাড়ে, শারীরিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, সমস্ত আত্মাজুড়ে নেমে আসে এক প্রকার প্রশান্তি। যার ফলে—নামাজ, জিকির, দরুদ, কুরআন তেলাওয়াত, ওজিফা আদায়ে আত্মার সংযোগ তৈরি করে। এবং জীবনকে অর্থবহ করে তুলে। নিজেকে খুঁটে খুঁটে দেখা বা জানার মাধ্যমে মানুষ তার অস্তিত্বের উৎস সন্ধানে নিমগ্ন হতে পারে। পৃথিবীতে এই আত্মভ্রমণ বা আত্ম সংযোগই একমাত্র নিজেকে জানার সহজ পথ। চিরঞ্জীব আল্লাহর নিকট হতে জীবনের দিক—দর্শন অনুসন্ধান করে এবং সে জীবন্ত দিক—দর্শন অনুসারে জীবন পরিচালনা করা।
মুরাকাবা—নিজের আত্মিক পবিত্রতা, নিয়তের পরিশুদ্ধতা, মানসিক প্রশান্তি, পরশ্রীকাতরতা, লোভ, হিংসা—বিদ্বেষ, লোক দেখানো মনোভাব ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়। দেহের যেমন আছে সুস্থতা—অসুস্থতা, মনেরও তেমনি রয়েছে সুখ—অসুখ। ভালোবাসা, হাসি, কান্না, ক্রোধ, দুঃখ—বিষাদ, ঘৃণা অবিশ্বাস।
ক্যারিয়ার—শিক্ষা কিংবা পরীক্ষা, দ্বন্ধ—হতাশা, মানসিক চাপ আমাদের নিত্যসঙ্গী। জীবনের তীব্র দহন, ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে সঠিকভাবে সচল এবং কর্মক্ষম থাকতে হলে জানতে হবে মন নিয়ন্ত্রণের কৌশল। আর এজন্য শিখতে হবে মেডিটেশন বা মুরাকাবা। মুরাকাবা বা মেডিটেশন হচ্ছে মন নিয়ন্ত্রণের প্রথম পদক্ষেপ। এটা নিজেই নিজের দেহের আরোগ্য ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে। টেনশনের সময় যে শক্তি ব্যয় হয়, তা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। মনের ঐ সব কাজকর্ম, যা আমাদের দেহকে অসুস্থ করে তুলে তাকে প্রতিরোধ করে। শরীরের কাঠামোকে সুস্থ সবল রাখার মতো শক্তি সঞ্চয় করে। এর নিজস্ব নির্মাণ কৌশল শরীরের ভেতরই ঘটে এবং এই সৌন্দর্যের মধ্য আপনি প্রশান্তি খুঁজে পাবেন। আপনি যতবেশি নিয়মিত মেডিটেশন অনুশীলন করবেন, ততই নিজের গভীরে যাবেন। আপনার শরীর স্বাস্থ্য থাকবে চমৎকার প্রাণবন্ত। দেশে ধ্যান অনুশীলনের অনেক বই, সিডি, প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি রয়েছে। সবার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এক নয়। আপনি যদি আধ্যাত্মিক মেডিটেশন বা সুফি মুরাকাবা শিখতে চান তাহলে সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন কর্তৃক মুরাকাবা কোর্স করুন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কোর্সের মতোই শিখতে হয়। সুফি মুরাকাবা কর্মসূচি এক পরম প্রশান্তিময় জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। ধ্যান কিংবা মেডিটেশনের আসল উদ্দেশ্য হল নিজেকে খোঁজা, নিজের সাথে পরিচিত হওয়া। ধ্যানে ডুব দিয়ে নিজেকে নিশ্চিত ভাবে খুঁজে পাওয়া গেলে কিংবা না গেলেও যা নিশ্চিত পাওয়া যায় তা হল ধ্যানের পজিটিভ সাইড ইফেক্টস। আসুন এবার ডুব দিই নিজের ভেতরে, প্রজ্ঞাময় জীবনের পথে।
কৃত: খাজা ওসমান ফারুকী
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন
প্রতিষ্ঠাতা, আলোকবর্তিকা